হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও ইসরায়েলের উপায় ছিল

জস পল


অক্টোবর ২২, ২০২৩
১২:৩৪ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২২, ২০২৩
১২:৩৪ অপরাহ্ন



হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও ইসরায়েলের উপায় ছিল

হামাসকে মোকাবিলায় ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা জস পল চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন। তার কাজের ক্ষেত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যান্য দেশে অস্ত্র সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তার চিন্তায় ছেদ টানে। তার পদত্যাগপত্র মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভেতরকার নানা বিষয় সামনে নিয়ে আসে। পলিটিকো

ম্যাগাজিনে সম্প্রতি তার একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। নাহাল টুসির নেওয়া সাক্ষাৎকারটির উল্লেখযোগ্য অংশ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন : আপনার পদত্যাগে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন ধরনের বার্তা বেশি পেয়েছেন?

জস পল : খুব বেশি ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। কিছুটা বিস্মিতও হয়েছি যেভাবে বিভিন্ন দপ্তরের সহকর্মী ও সাবেক সহকর্মী, এমনকি অন্যরাও আমাকে বার্তা দিয়েছে।

প্রশ্ন : তারা কী বলছে?

জস পল : সহকর্মীরা আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে যা আমি আশা করিনি। ইসরায়েলকে সমালোচনা করার ধারণা কিছুটা বিতর্কিত। আমি ভেবেছিলাম সবাই যতটুকু পারা যায় এর থেকে দূরে থাকতে চাইবে। তারা বলেছে ‘আমরা বুঝি তুমি কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছ। আমরা তোমাকে সমর্থন করি। এটা সত্যিই কঠিন, এবং এর সঙ্গে আমরাও কুলিয়ে উঠছি না।’

প্রশ্ন : আপনার জন্য গত কয়েকদিনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী ছিল? কোনো বিশেষ সময়ের কথা বলবেন কি না?

জস পল : আমি গত ৭ অক্টোবর থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিলাম এবং অবশ্যই স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়, কী করা যায় তার আলোচনায় যুক্ত ছিলাম। তবে এই সময় যথেষ্ট আলোচনার অভাব বোধ করেছি। প্রথাগতভাবে যখন কোনো বিতর্কিত অস্ত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তখন সাধারণত কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি কখনো কখনো বছরব্যাপী আলোচনা হয়। এই ক্ষেত্রে তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। বিভিন্ন মাধ্যমে আমি যার চেষ্টা করেছিলাম কয়েকবার কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। এসবের পর আমার মনে হয়েছে এটি অন্য অস্ত্র সরবরাহের ঘটনাগুলোর মতো না। তাই এখানে পদত্যাগই একমাত্র উপায়, যাতে বিষয়টিকে উত্থাপন করা যাবে এবং জনসম্মুখে নিয়ে আসা যাবে।

প্রশ্ন : ঘটনার সময় আপনি কি ছুটিতে ছিলেন না?

জস পল : হ্যাঁ, কিন্তু করোনার পর থেকে সত্যিকারের ছুটি বলে কিছু নেই। আমরা সবাই দূরে থেকেও কাজ করছিলাম, আমি ই-মেইল ও ফোনে যোগাযোগ রাখছিলাম। আমি কিছুটা দূরে ছিলাম, যেটা আমাকে পরিস্থিতিকে একটু ভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সহায়তা করেছে কিন্তু আমি কখনোই আলোচনার বাইরে ছিলাম না।

প্রশ্ন : পদত্যাগ করার আগে কি আপনি অভ্যন্তরীণভাবে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন। এবং আপনি অন্য কোনো উপায় আপনার ভিন্ন মত উত্থাপন করেছিলেন কিনা? যেমন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ভিন্নমত গ্রহণের প্রচলিত চ্যানেলের মাধ্যমে?

জস পল : অবশ্যই, হামাসের আক্রমণের পরে আমি আমার কিছু নেতৃস্থানীয় সহকর্মীকে একটি ই-মেইল করি এবং বলি আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা দরকার। এবং জানাই তাড়াহুড়ো করে সামরিক সহযোগিতা প্রদান না করে আমাদের ভাবা উচিত কেন এই ধরনের সহযোগিতা অতীতে কাজ করেনি এবং এইবার ভিন্নভাবে আমরা কী করতে পারি? আমি বলি আমাদের সামরিক সহযোগিতা প্রদানে তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না, আমাদের আরও সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অনানুষ্ঠানিকভাবে সহকর্মীদের কেউ কেউ আমার মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে, কিন্তু আমি কোনো গ্রহণযোগ্য উত্তর পাইনি। পরবর্তী সময়ে পুরো সপ্তাহ জুড়ে বিভিন্ন সময় আমার সহকর্মীদের কাছে বিষয়টি আবার উত্থাপন করছিলাম, যাদের মধ্যে অধিদপ্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ছিলেন। তবে এই ঘটনার ক্ষেত্রে আমি ভিন্নমত উত্থাপনে প্রচলিত চ্যানেলে করিনি। কারণ, আমি দেখেছি ভিন্নমত উত্থাপনের চ্যানেল অতটা কার্যকর না।

প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন ‘এই ঘটনায় আমাদের আরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত’ এর পেছনে আপনার যুক্তি কী ছিল?

জস পল : আমি আমার ই-মেইল থেকে আপনাকে উদ্ধৃতি দিতে পারি। আমি বলেছি ‘সামরিক উপায়ে ভবিষ্যতের শান্তি অর্জন করা সম্ভব না, এটি করতে হবে কূটনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে, ভয় সৃষ্টি করার মাধ্যমে নয়, কিন্তু বিশ্বাস স্থাপন করার মাধ্যমে, শত্রুকে হত্যা করার মাধ্যমে নয়, কিন্তু বন্ধুত্ব স্থাপন করার মাধ্যমে, অন্যকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে নয়, কিন্তু আশা জাগিয়ে। এসব কিছু বিবেচনায় এই মুহূর্তে ইসরায়েলে যা ঘটছে তা একটি বিয়োগান্ত ঘটনা শুধু প্রাণহানির জন্য না বরং ভবিষ্যতের শান্তির জন্যও, নতুন একটি প্রজন্মের জন্যও যার সম্ভাবনা আমরা বন্ধ করে দিচ্ছি।... এই সংঘাতে প্রত্যেকেই হারাচ্ছে, এবং এটি যতই দীর্ঘস্থায়ী হবে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তত বেশি হবে।’

প্রশ্ন : এই ই-মেইলটাই আপনি পাঠিয়েছেন?

জস পল : সত্যি তাই। আমি জানি এটি একটি অজনপ্রিয় কাজ কিন্তু সম্ভবত সামরিক সাহায্য পাওয়া এই মুহূর্তে ইসরায়েলের জন্য সর্বোত্তম না, যা তাদের ফিলিস্তিনিদের প্রশ্নকে অগ্রাহ্য করতে প্রভাবিত করবে। অন্যভাবে বলা যায়, আমরা যদি কয়েক দশক ধরে প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার না দিতাম তাহলে তারা অসলো শান্তি প্রক্রিয়ায় আরও বেশি আগ্রহী হতো, আমাদের আর আজকের অবস্থানে থাকতে হতো না।

প্রশ্ন : আপনি বলছেন, একই যুক্তি আপনি আগেও উত্থাপন করেছেন?

জস পল : করেছি, শুধু ইসরায়েলকে উপলক্ষ করে নয়। এরকম আরও বিতর্কিত অস্ত্র সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রেও করেছি।

প্রশ্ন : এবং এবার তাদের উত্তর ছিল, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি।’

জস পল : একদম তাই।

প্রশ্ন : বছরের পর বছর আপনি মানবাধিকার চর্চায় দুর্বল এমন অনেক রেজিমের কাছে অস্ত্র বিক্রিতে সহযোগিতা করেছেন। সেক্ষেত্রে ইসরায়েল ভিন্ন কেন হবে? এটা মিসর ও সৌদি আরব থেকেও কি আলাদা?

জস পল : না, আমি বলছি না যে, ইসরায়েল মিসর বা সৌদি আরব থেকেও বাজে। আপনি বলেছেন আমি এই দেশগুলোর সঙ্গে অস্ত্র বিক্রিতে সহযোগিতা করেছি। আমি বলব, এই ধরনের রেজিমগুলোর সঙ্গে অস্ত্র বিক্রিতে আমি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছি ও বিলম্বিত করেছি।

প্রশ্ন : আরেকটু পরিষ্কার হওয়ার জন্য, ইসরায়েল কি মিসর, সৌদি আরব বা অন্যদের থেকে আলাদা? আমি বোঝাতে চাচ্ছি তারা যেভাবে আমাদের অস্ত্র ব্যবহার করে?

জস পল : আমি যা বোঝাতে চাই, প্রত্যেকটি অস্থিতিশীল দেশই নিজেদের মতো করে অস্থিতিশীল। তবে পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্নতা আছে। সৌদিরা সৌদিদের ওপর আঘাত করছে, মিসরীয়রা মিসরীয়দের ওপর আঘাত করছে, কিন্তু ইসরায়েলিরা যাদের আঘাত করছে তারা ইসরায়েলি নয়। অন্যদের তুলনায় এটা একটা ভিন্ন পরিস্থিতি, তবে আমি খারাপের তারতম্য নিয়ে তুলনা করতে চাই না।

প্রশ্ন : আপনি আপনার পদত্যাগপত্রে বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের কর্মপদ্ধতি ছিল, ‘পক্ষপাতমূলত আবেগপ্রবণ প্রক্রিয়া, রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক, বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব ও আমলাতান্ত্রিক প্রথা মাফিক।’ আপনি কি এ সম্পর্কে আরেকটু ব্যাখ্যা করতে পারেন?

জস পল : আবেগ প্রবণ এই অর্থে যে, এটা হামাসের নির্মম আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় করা হয়েছে। পক্ষপাতমূলক এই অর্থে, আমরা সবসময় ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলি, কিন্তু এটা আমরা কখনো ভিন্নভাবে দেখি না যেখানে ইসরাইল পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের গ্রামগুলোর ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ করছে, গাজা ও পশ্চিম তীরে বাড়িঘর ধসিয়ে দিচ্ছে।

রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক এই অর্থে বাইডেন প্রশাসনকে রিপাবলিকান, এমনকি নিজ দলে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও ইসরায়েল বিষয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হচ্ছে যে, কে বেশি ইসরায়েলের পক্ষে তা প্রমাণ করার জন্য। বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব এই জন্য যে, গত বিশ বছর ধরে ইসরায়েলের প্রতি আমাদের নিরাপত্তা ও শান্তি নিয়ে প্রতিশ্রুতির কোনোটাই আনতে পারেনি; বাস্তবে একে আরও অনিরাপদ করেছি, এবং শান্তিকে করেছি সুদূর পরাহত। আমলাতান্ত্রিক প্রথা এই জন্য, যেহেতু এটা ইসরাইল সম্পর্কিত ইস্যু অতএব একই ধরনের প্রতিউত্তর যেটা আমরা সবসময়ই করি।

প্রশ্ন : ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে ভিন্ন উপায় কী হতে পারে, সহযোগিতা বন্ধ করা কি হামাস ও অন্য চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে আবার আক্রমণে উৎসাহিত করবে না?

জস পল : না, এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিত আছে। প্রথমত এই ধরনের উদ্যোগ অতীতে কাজ করেনি। আপনি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলকে শুনেছেন, তারা বলেছে, ‘হামাসকে ধ্বংস করার জন্য এটা একটা সামরিক পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে।’ সম্ভবত সংগঠন হিসেবে আপনারা হামসকে ধ্বংস করতে পারবেন, কিন্তু হামস যা এবং হামাস সামরিক উপায়ে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাকে ধ্বংস করতে পারবেন না। এর একটি রাজনৈতিক সমাধান দরকার, সামরিক উপায় রাজনৈতিক সমাধান থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

প্রশ্ন : আপনি এই সংঘাত নিয়ে অনেক জানেন, এই বিষয়গুলো আপনি কাছ থেকে দেখেছেন, রামাল্লায় থেকেছেন এবং ইসরায়েলি ও ফিলিস্থিনি উভয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন, আপনার দৃষ্টিতে সবাইকে কোন বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা উচিত।

জস পল : অনেকেই এই সংঘাতের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলবে, কিন্তু আমি মনে করি না এটাই সঠিক। আমি মনে করি এই মুহূর্তে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনকার ভীতিকর অভিজ্ঞতাসমূহ বোঝা। সবাইকে বুঝতে হবে উভয় পক্ষে অনেক বেসামরিক মানুষ এর ভুক্তভোগী এদের বেশিরভাগ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে চায়।

প্রশ্ন : আঞ্চলিক যুদ্ধের হুমকি থেকেও কি আমাদের অস্ত্র সহযোগিতা করা উচিত না?

জস পল : আমরা সেটা ইতিমধ্যে করেছি। বাইডেন প্রশাসন পূর্ব-ভূমধ্যসাগরে দুটি বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়েছে, যা নিশ্চয়ই হিজবুল্লাহ ও ইরানকে বার্তা দিয়েছে।

প্রশ্ন : বাইডেন প্রশাসনের প্রতি আপনার বার্তা কী, এই সংকট মোকাবিলায় কী করা উচিত?

জস পল : অস্ত্র সরবরাহ প্রসঙ্গে আমি বলব বাইডেন প্রশাসন নিজস্ব গ্রহণ করা নীতি আবারও পর্যালোচনা করে দেখুক। এই প্রশাসনই ফেব্রুয়ারিতে প্রথাগত অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কিত একটি নীতি গ্রহণ করেছে যাতে কিছু মানদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

আরসি-১১