হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে ক্ষোভ এবং মেয়রের উদ্যোগ

আহমেদ নূর


মে ২২, ২০২৪
০৪:৩৪ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ২২, ২০২৪
০৪:৩৪ অপরাহ্ন



হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে ক্ষোভ এবং মেয়রের উদ্যোগ
মন্তব্য প্রতিবেদন


প্রায় এক মাস ধরে সিলেট নগর উত্তপ্ত। নাগরিকেরা ভেতরে-বাইরে সংক্ষুব্ধও। একদিকে প্রকৃতিতে তাপদাহ, অন্যদিকে রাজপথে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ । রাজপথে উত্তাপের কারণ-বর্ধিত হারে নগরের হোল্ডিং ট্যাক্স। হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য নগরবাসীকে আশানুরূপ স্বস্তি দিতে পারেনি। মেয়র নিজে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে হোল্ডিং ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার আশ্বাস দিয়েছেন। একইসঙ্গে এ ব্যাপারে কয়েকটি ধাপে কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেটি করা হবে বলেও জানিয়েছেন। তিনি আপত্তি জানানোর কথা বলেছেন, আপত্তির সময় বাড়িয়েছেন এবং বকেয়া কর এবং বাস্তব অবস্থাও তুলে ধরেছেন। কিন্তু এতে খুব একটা সুফল মেলেনি। নগরবাসীর ক্ষোভ যেমন ছিল তেমনটিই রয়ে গেছে। কোথায় যেন আস্থা- বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী গত বছর ৭ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই হিসাবে এখনও ছয় মাস হয়নি। চার মাসের মধ্যেই বর্ধিত ট্যাক্স নিয়ে তাঁকে একটা চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। বিষয়টি অবশ্যই তাঁর জন্য বিব্রতকর, কারণ কোনো জনপ্রতিনিধি কখনোই চান না তাঁর অর্জিত জনপ্ৰিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হোক। একইভাবে তিনি এটাও নিশ্চয়ই চান না যে, নগর সংস্থার কোনো সিদ্ধান্তে নাগরিকরা চাপে পড়েন, ক্ষুব্ধ হন। যে-কারণে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে যখন জনমনে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, ঠিক তখনই তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তাঁর অবস্থান এবং করণীয় সম্পর্কে জানান দিয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। গত ১২ মে তিনি সংবাদ সম্মেলন করার পর প্রায় ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও অসন্তুষ্ট নগরবাসী তাদের ক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিদিন সভা- সমাবেশ, মানববন্ধন এবং মেয়র বরাবরে স্মারকলিপি দিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন। সরকারি দল ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিলের দাবিতে শুধুমাত্র এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। আজ, ২২ মে, 'সিলেটের নাগরিকবৃন্দ' নামে সংগঠনের ব্যানারে নগরের ৪২ ওয়ার্ডের বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সুধী সমাজকে নিয়ে মতবিনিময় সভার অনুষ্ঠানের ডাক দিয়েছে।

বর্ধিত হারে হোল্ডিং ট্যাক্স আরোপের প্রতিবাদে যেসব সংগঠন বা যারা প্রতিবাদ করছেন তাদের বক্তব্য নিয়মিত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। ব্যক্তিপর্যায়েও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যার সারাংশ হচ্ছে-এই ট্যাক্স আরোপ ‘সম্পূর্ণ অযৌক্তিক' ‘অবিবেচনাপ্রসূত' এবং ‘অবাস্তব’। নগরের বিভিন্ন ভবনে ট্যাক্স আরোপের ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগও রয়েছে। তাছাড়া আন্দোলনকারীদের মতে, হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে তাতে অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে যখন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে মানুষ দিশেহারা অবস্থায় তখন হোল্ডিং ট্যাক্স ‘অস্বাভাবিক' হারে ‘কয়েকশ গুণ' বাড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই নাগরিকবান্ধব কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তাই এটা বাতিল করে পুনরায় বাস্তবতার নিরিখে স্বচ্ছতার সঙ্গে ট্যাক্স নির্ধারণের দাবি তারা জানাচ্ছেন।

অন্যদিকে, নগর সংস্থার বক্তব্য হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে নগরে কোনো হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেও ট্যাক্স আহরণ বৃদ্ধির নির্দেশনা রয়েছে। বর্তমান বর্ধিত ট্যাক্স নির্ধারণ ও

মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনকৃত। তাও চার বছর আগে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু নানাবিধ কারণে সেটি তখন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। এখন সেটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি সিটি করপোরেশনে ট্যাক্স আদায়ের একটি লক্ষ্যমাত্রাও সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করে দেওয়া হয় বলে জানা যায়। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ে কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কিংবা সরকার ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে বাস্তবায়নের বিধানও রয়েছে। সুতরাং ট্যাক্স বাড়ানো ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর নেই । আমাদের মতে, উভয়ের বক্তব্যে যুক্তি আছে, কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রশ্নাতীত নয়। দীর্ঘদিন কোনো ট্যাক্স না বাড়িয়ে হুট করে বিশাল পরিমাণের ট্যাক্স চাপিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। এই চাপ বিভিন্নভাবে সমাজের সকল শ্রেণির উপর পড়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকিং খাত নিয়ে আশংকাসহ নানারকম অর্থনৈতিক সংকট জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে, সেই সময় এমনতর সিদ্ধান্তগ্রহণের আগে চিন্তাভাবনা করা দরকার ছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে জরুরি ছিল ট্যাক্স আরোপের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও। দেখা গেছে, অনেক বহুতল ভবনের মালিকের ট্যাক্স যত টাকা তার চেয়ে বেশি এক তলা ভবনের একজন মালিকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না বলেই মনে হয় ।

নগরের সেবাসমূহ পেতে হলে হোল্ডিং ট্যাক্স দিতেই হবে। সব দেশেই ট্যাক্স দিতে হয়। তবে এক্ষেত্রে অনেকগুলো বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা খুলনা সিটি করপোরেশন এবং সিলেট সিটি করপোরেশন এক নয়। এখানে শিল্প-কারখানা নেই। অনেক পরিবার আছে যারা ঘর ভাড়া দিয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহ করে। তাই এসব বাস্তবতা মাথায় রেখেই নাগরিককে চাপে না ফেলে ট্যাক্স আরোপ করতে হবে। পাশাপাশি করের আওতা বাড়াতে হবে এবং বকেয়া ট্যাক্স আদায়ের জন্য বাস্তবসমম্মত উদ্যোগ নিতে হবে। সিলেট সিটি করপোরেশনের কয়েক কোটি টাকা বকেয়া হোল্ডিং ট্যাক্স রয়েছে। গত কয়েক দিনে আপত্তি জানাতে গিয়ে চাপে পড়ে অনেকে বকেয়া পরিশোধ করেছেন। সেটার পরিমাণও কয়েক লাখ টাকা। বকেয়া ট্যাক্স আদায় করতে পারলে নগর সংস্থা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারত । তাই বকেয়া আদায়ে নোটিশ প্রদান, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রয়োজনে নিয়মিত অভিযান চালানো যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হলো ট্যাক্স প্রদানের জন্য সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, সাধারণ নাগরিকদের করভীতি দূরীকরণ এবং নগর কর্তৃপক্ষের প্রতি সকল স্তরের মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন। এই সবকিছু তখনই সম্ভব যখন স্বচ্ছ ও যুক্তিসংগত নীতিমালার মাধ্যমে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করা হবে।

আশার কথা সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র স্টেকহোল্ডার এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নিয়েছেন। আজ (২২ মে) এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। এই উদ্যোগের জন্য মেয়র অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার । আমরা আশা করব, আজ মেয়র সবার বক্তব্য শুনবেন। যৌক্তিকতা অনুধাবন করবেন এবং কাঙ্ক্ষিত বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেবেন। যেহেতু বিভিন্ন মহল থেকে আরোপিত ট্যাক্স নিয়ে আপত্তি উঠেছে তাই সেটা স্থগিত করবেন। সবার মতামত নিয়ে আবারও পুনর্মূল্যায়ন করবেন। তারপর মেয়র মহোদয়েরই যেটি চাওয়া ‘সহনীয় পর্যায়ে' ট্যাক্স নিয়ে আসুন। একটা কথা মনে রাখতে হবে-আইন মানুষের জন্য, কিন্তু আইনের জন্য মানুষ নয় । আর জনপ্রতিনিধিতো জণগণের জন্যই । তাদের সুখে-দুঃখে যিনি পাশে থাকেন, বুকে আগলে ধরেন, সমস্যার সমাধান দেন- তিনিই তো প্রকৃত জনপ্রতিনিধি ।

আশা করি আজকের এই মতবিনিময় সভায় সংশ্লিষ্ট সবাই অংশ নেবেন। মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে মেয়রকে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করবেন। মনে-প্রাণে চাইব কোনোভাবেই যেন এই উদ্যোগ ব্যর্থ না হয়। সিলেটের প্রকৃতি এখন অনেকটা সহনীয়। রাজপথের উত্তাপও সহনীয় হোক ।


লেখক: সম্পাদক, সিলেট মিরর