মেয়রকে ধন্যবাদ ও প্রসঙ্গকথা

আহমেদ নূর


মে ২৬, ২০২৪
০৬:৫৪ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ২৬, ২০২৪
০৭:৫৫ অপরাহ্ন



মেয়রকে ধন্যবাদ ও প্রসঙ্গকথা
বিশেষ লেখা


গতকাল শনিবার ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি। তাঁর লেখনিতে সবসময় ফুঁটে ওঠেছে সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ার আকাঙ্খা। একইসঙ্গে নজরুল চেয়েছিলেন মানুষ সচেতন ও প্রতিবাদী হয়ে উঠুক এবং নিজের অধিকার আদায় করে নিতে শিখুক। কবি নজরুলের একটি কবিতার লাইন-শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা, সত্যসিন্ধু জলে’।

সিলেট নগরের বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে সম্প্রতি নাগরিকরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেন। মেয়র বিষয়টি অনুধাবন করে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। শেষ পর্যন্ত জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। এই পরিস্থিতিতে জাতীয় কবির লেখনির অন্তর্নিহিত ভাবনা ও পংক্তিগুলো স্মরণে আসা খুবই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হারে বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্সের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য মাননীয় মেয়র এবং তাঁর পরিষদকে ধন্যবাদ। যথাসময়ে তাঁরা যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। একইসঙ্গে যারা প্রতিবাদী হয়েছিলেন তাদেরকেও ধন্যবাদ। সবাই সোচ্চার না হলে হয়ত বিষয়টি এতো দ্রুত উপলব্ধির পর্যায়ে যেত না। 

গত শুক্রবার রাতে মেয়র ও তাঁর পরিষদ সভা করে বর্ধিত হোল্ডিং ট্যাক্স বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করার কথাও বলেছেন। একইসঙ্গে বকেয়া কর (আগে যা নির্ধারিত ছিল) পরিশোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। আমি মনে করি, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে নগরের সবাই একমত হবেন। বকেয়া কর পরিশোধ অবশ্যই করতে হবে। সেই কর নিয়ে তো কারো আপত্তি নেই। তাহলে বকেয়া থাকবে কেন? আর যদি কোটি কোটি টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স বকেয়া থেকে যায় তাহলে নগর সংন্থা চলবে কী করে? 

আমি আগেও লিখেছি, বকেয়া আদায়ে নোটিশ প্রদান, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, প্রয়োজনে নিয়মিত অভিযান চালাতে পারে সিটি করপোরেশন। সেটা নিয়ে কেউ আপত্তি তুলবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো ট্যাক্স প্রদানের জন্য সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, সাধারণ নাগরিকদের করভীতি দূরীকরণ এবং নগর কর্তৃপক্ষের প্রতি সকল স্তরের মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জন। এই সবকিছু তখনই সম্ভব যখন স্বচ্ছ ও যুক্তিসংগত নীতিমালার মাধ্যমে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।  

এ সংক্রান্ত আগের লেখা পড়ুন-

হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে ক্ষোভ এবং মেয়রের উদ্যোগ

নগর সংস্থার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলতে চাই। মাননীয় মেয়রসহ কাউন্সিলরবৃন্দ এবং কর্মকর্তা যারা আছেন তারা যদি কথাগুলো বাস্তবসম্মত এবং যৌক্তিক মনে করেন তাহলে ভেবে দেখতে পারেন। ভাবার অনেক কিছুই আছে।আর ভাবতে পারলে সমস্যার খোঁজ মিলবে এবং সবই সমাধান করা সম্ভব হবে। যে কোটি কোটি টাকা বকেয়া হোল্ডিং ট্যাক্স রয়েছে সেগুলো আদায় করা গেল না কেন? এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। ট্যাক্স বাড়ানোর আগে বকেয়া আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। অতীতে আমরা দেখেছি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বকেয়াট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করায় অভিযান পরিচালনা করে আদায় করা হয়েছে। এমনকি জরিমানাও করা হয়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। নতুন মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারতো। কিন্তু তা না করে দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় বর্ধিত ট্যাক্স আরোপের মতো অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে কারা তাঁকে উৎসাহিত করলেন? কেন করলেন? দায়িত্ব গ্রহণের পর মেয়র নগরের সড়ক ও ফুটপাত হকারমুক্ত করেছেন। সড়কগুলোতে নতুন কার্পেটিং করেছেনযা এখনও চলমান। জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণ করেছেন দীর্ঘদিন সময় নিয়ে। রমজান মাসেও মানুষকে উন্নয়ন কাজের জন্য চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কিন্তু নগরবাসী টু শব্দটি করেননি। হঠাৎ নগরবাসী ক্ষেপিয়ে তোলার পেছনে রহস্যটা কী তা খুঁজে বের করতে হবে। এ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। 

সিলেট সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগ রয়েছে। একজন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাও রয়েছেন। নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। গত বৃহস্পতিবার হোল্ডিং ট্যাক্স নিয়ে মতবিনিময় সভায় ট্যাক্স আরোপের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার সময় উপস্থিত নাগরিকদের তোপের মুখে পড়েন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা। পরে পরিস্থিতি সামাল দেন মেয়র। রাজস্ব কর্মকর্তাকে মাঝপথেই থামতে হয়। মানুষ তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। এখানে ভাবনার বিষয় বকেয়া ট্যাক্স আদায়ে রাজস্ব বিভাগ কোনো উদ্যোগ নেয়নি কেন? হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড়াও ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য খাতের কত টাকা বকেয়া আছে সেটাতো রাজস্ব বিভাগ জানে। সেগুলো আদায়ের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো না কেন? 

বর্ধিত যে ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছিল সেটি চার বছর আগের সিদ্ধান্ত বলে জানা গেছে। তখন মেয়র ছিলেন বিরোধী দলের। বর্তমান মেয়র সরকারি দলের। তাঁর পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব ও সহজ; যতটা আগের মেয়রের পক্ষে সম্ভব হতো না। কিন্তু ভাববার বিষয় হলো বিরোধী দলের মেয়র যদি বর্ধিত ট্যাক্স চার বছর আটকে রাখতে পারে তাহলে কী সরকার দলের মেয়র সেটি চার মাসও আটকে রাখতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। চার মাস কেন অনেকদিন আটকে রাখা কিংবা আরও অনেক কিছু তিনি করতে পারতেন। বলতে গেলে নতুন মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের হানিমুন পিরিয়ড চলছে। ছয় মাসও হয়নি। কিন্তু চার মাসের মধ্যে তাঁকে চাপে ফেলা হলো কেন? এটা কোনো ‘কূটকৌশল’ নাকি তাঁকে ‘সাবোটাজ’ করা হলো। এগুলো ভাবতে হবে। 

সিটি করপোরেশনের কর হোল্ডিং ট্যাক্স সম্পর্কিত একটি নাগরিক হ্যান্ডবুক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২১ সালে এটি প্রকাশ করে। এই হ্যান্ডবুকের ২.৪ ধারায় করারোপের মূল নীতিসমুহ সম্পর্কে বলা আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা, টেকসই ও ধারাবাহিকতা, সরলতা এবং জবাবদিহিতা। আমার তো মনে হয়এই মূলনীতিগুলোই কর আরোপের জন্য, মানুষের স্বস্তির জন্য যথেষ্ট। তারপরও একটু ব্যাখ্যা করা যাক। সেই হ্যান্ডবুকেই বলা আছে‘ন্যায্যতা মানে কর আরোপ পদ্ধতি স্বচ্ছ ও ন্যায্য হওয়া বাঞ্চণীয়। ন্যায্যতার তিনটি দিক রয়েছে, এগুলো হচ্ছে অর্থ প্রদানের ক্ষমতা, বৈষম্যহীনতা ও উপকারভোগের নীতিমালা।’ টেকসই ও ধারাবাহিকতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘করদাতাদের আয় একই থাকলে বছর বছর করের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস-বৃদ্ধি করা উচিত নয়। উল্লেখ্য, স্থিতিশীলতার অর্থ এই নয় যে, কর ব্যবস্থা কঠোর হতে হবে।’

আমাদের নাগরিকদের কাছে এই হ্যান্ডবুক কতটা পৌছেছে জানি না। কর আরোপের সঙ্গে জড়িত যারা আছেন তাদের কতজন এটি সম্যক উপলব্ধি করেছেন কিংবা মনোযোগ সহকারে পড়েছেন তাও প্রশ্নাতীত নয়। তাই আমাদের আরও বেশি বেশি ভাবতে হবে। মানুষের কষ্টের কথা ভাবতে হবে। পরিত্রাণের উপায়ের বিষয়ে ভাবতে হবে। বৈষম্য দূর করার কথা ভাবতে হবে। কীভাবে আস্থার স্থান তৈরি করা যায় সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। নতুন মেয়র অনেক কিছু করতে পারবেন এটা নগরবাসীর বিশ্বাস রয়েছে। তাঁকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সেটা ভাবতে হবে। নগর ভবনের সার্বিক বাস্তবতা মেয়রকে জানতে হবে, জানাতে হবে। নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে ন্যায়-নীতি ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা ভাবতে হবে। 

সিলেটকে বলা হয় আধ্যাত্নিক রাজধানী। আমাদের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান এই শব্দটি প্রায়ই উচ্চারণ করতেন। এই আধ্যাত্নিক নগরে অনিয়ম, অপকর্ম করে কেউ পার পায়নি কোনোদিন। ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’ বলে একটা কথা আছে। যারা এর ফলভোগ করেছেন তারা তো জানেনই, আমরাও অনেককিছু জানি। সিলেটের সাংবাদিকরা ভালো করেই জানেন। সুতরাং মাত্র শুরু। যারা ভাবার ভাবেন। নতুবা কোনো এক সময় হয়তো পস্তাতেও হতে পারে। 



এএফ/০১