দেশজুড়ে সংঘাত, কারফিউয়ে সিলেটের পর্যটনে ধস

কবির আহমদ, কোম্পানীগঞ্জ


জুলাই ২৬, ২০২৪
০৩:২৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২৬, ২০২৪
০৩:২৭ অপরাহ্ন



দেশজুড়ে সংঘাত, কারফিউয়ে সিলেটের পর্যটনে ধস
বুকিং নেই হোটেল, রেস্তোরায়


ঈদ মৌসুমে বন্যা ও দেশে চলমান কোটা সংষ্কার আন্দোলনে দেশ জুড়ে সংঘাত, সংঘর্ষে আহত ও নিহতের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সরকার দেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে। এ পরিস্থিতিতে প্রভাব পড়েছে প্রকৃতি কন্যা সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে। পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ মৌসুমে বন্যা ও গেল কয়েকদিন ধরে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। 

সিলেটের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুলসহ সকল পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় হোটেল ও রেস্তোরায় বুকিং না থাকায় পর্যটক ব্যবসায় ধস নেমেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কর্মহীন অলস সময় পার করছেন পর্যটন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। 

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণত প্রতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভ্রমণ পিপাসু লাখের অধিক মানুষ ভ্রমণ করতে আসতেন এখানে। মাসে চার থেকে পাঁচ লাখের অধিক পর্যটক আনাগোনা করতেন সাদা পাথর এলাকায়। ঈদ মৌসুমে পর্যটকদের আগাগোনা বৃদ্ধি পেত কয়েকগুণ। এবার ঈদের দিন থেকে সিলেটে বন্যা শুরু হওয়ায় ঈদ মৌসুমে পর্যটকদের আগমন ছিল না। পর্যটন এলাকার হোটেল, রেস্তোরা, কসমেটিকস ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা মাসে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেননি। কিন্তু ঈদ মৌসুমে বন্যা ও বর্তমানে কোটা আন্দোলনের অস্থিরতার কারণে পর্যটন কেন্দ্রে বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটকরা আসা দূরের কথা সিলেটের স্থানীয়রাও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আসছেন না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত একমাসের অধিক সময়ে ১০ হাজার পর্যটকও আসেন নি। যার ফলে সাদা পাথর পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়ীদের চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা হয়নি। 

জাফলং পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ মৌসুমে বন্যা ও পরবর্তী সময়ে দেশে অস্থিরতার কারণে পর্যটকদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় চরম মন্দা পর্যটন ব্যবসায়। তাঁরা বলেছেন, জাফলং পর্যটন কেন্দ্রের যেসব স্থানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকদের আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকতো সেসব স্থানে সুনশান নীরবতা। পর্যটক ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন। 

জাফলং পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. হোসেন মিয়া সিলেট মিররকে বলেন, জাফলং এলাকায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট রেস্তোরাঁ, হোটেল ও রিসোর্টসহ প্রায় ৫ শতাধিক দোকান রয়েছে এবং এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছে হাজার হাজার মানুষ। ঈদের দিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত দৈনিক পর্যটকদের আগমনের সংখ্যা শতাধিকের কোটায়। পর্যটকদের আনাগোনা কম থাকায় চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে।’ তিনি বলেন, ঈদের মৌসুমে আমাদের বড় ব্যবসা হয়। কিন্তু এ ঈদে বন্যা পরিস্থিতির কারণে আমাদের কোনো ব্যবসা হয়নি। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভেবেছিলাম মোটামুটি ভালো কিছু ব্যবসা হবে। কিন্তু কোটা আন্দোলনের কারণে সংঘাত-সংঘর্ষ ও কারফিউ চলমান থাকায় পর্যটকদের আগমনের হার এখন শূন্যের কোটায় চলে এসেছে। যার ফলে আমাদের দৈনিক লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। 

তিনি আরও বলেন, জাফলং এলাকার প্রায় তিন শতাধিক ফটোগ্রাফার রয়েছে। পর্যটক না আসায় ফটোগ্রাফাররা বেকার হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আয় বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে পড়েছে বিপাকে। 

সাদা পাথর পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সফাত উল্লাহ জানান, পর্যটন এলাকার শতাধিক কসমেটিকসের দেকাান, ১০টি রেস্তোরা, কয়েকটি হোটেল, রিসোর্ট, শতাধিক ভাসমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শত শত নৌকা রয়েছে। এ সকল ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। ঈদ মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার ব্যবসা হয় সাদাপাথর এলাকায়। কিন্তু বন্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত এক মাসে আমাদের ৯০ শতাংশ ব্যবসা কমে গেছে। এতে করে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সকল ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের দিন থেকে সিলেটে বন্যা শুরু হওয়ায় এ ঈদে সিলেটে পর্যটক আসেনি। বন্যা পরবর্তী সময়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অস্থিরতা ও কারফিউ জারির কারণে জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসায় মানুষ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভিড় করছে না বলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চরম মন্দা যাচ্ছে। 

জাফলং গ্রীন রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাবলু বখত জানান, ঈদের দিন থেকৈ এখন পর্যন্ত রুম বুকিংয়ের অবস্থা চরম খারাপ। ঈদের সময় বন্যার কারণে সিলেটের পর্যটক আসা কমে যাওয়াতে আমাদের ঈদের ব্যবসা হয়নি। এতে এ বছরের ব্যবসায় বড় ধাক্কা খেয়েছি। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর কয়েক দিন পর্যটক আসা শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ কোটা সংষ্কার আন্দোলনের কারণে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে পর্যটকেরা ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগই পাচ্ছেন না। সুতরাং ভ্রমণ করবে কিভাবে। এতে করে এ মৌসুমে ব্যবসায় এক কথায় ধস নেমেছে। 


সরেজমিনে ‘ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় নৌকা ঘাটে সুনশান নীরবতা। পর্যটকদের অপেক্ষায় সারিবদ্ধভাবে শত শত নৌকা নদীর ঘাটে বাঁধা রয়েছে। কিন্তু পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না নৌকার মাঝিদের। নৌকাঘাটের পাশে শত শত দোকানের মাঝে হাতেগোনা কয়েকটি দোকান খোলা থাকলেও বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট খোলা থাকলেও খালি পড়ে আছে চেয়ারগুলো। পর্যটক না থাকায় দোকানপাট বন্ধ করে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। যারাই দোকান খুলেছেন বা নৌকা নিয়ে ঘাটে এসেছেন তারা অলস সময় পার করেছেন। মোবাইলে বিভিন্ন ধরণের গেম খেলে ও দেশের অস্থিরতা নিয়ে আলাপ আলোচনায় সময় পার করছেন। 

নৌকার মাঝি নয়াগাঙ্গের পাড় গ্রামের তারেক আহমদ সিলেট মিররকে জানান, পর্যটন ঘাটে প্রায় দেড়শ নৌকা আছে। প্রতিটি নৌকা দৈনিক ৩ থেকে ৫টি ট্রিপ দেয়। ছুটির দিনে পর্যটক বেশি থাকায় ৫ থেকে ১০টি ট্রিপ দেওয়া যায়। কিন্তু গত এক মাসের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন কারণে পর্যটকরা না আসায় বেশির ভাগ নৌকা ঘাটেই আসছে না। যারাই আসছে তারা একটি করেও ট্রিপ দিতে পারছে না। গত কয়েক দিন ধরে সিলেটের বাইরের কোনো পর্যটক আসছে না। স্থানীয় সামান্য কিছু মানুষ আসছে বলে গত ১০ দিনে আমি মাত্র ৫টি ট্রিপ দিয়েছি। এতে যা আয় হয়েছে তা দিয়ে আমার বাড়ি থেকে নৌকাঘাটে আসা-যাওয়া ও খাওয়ার খরচ করে পরিবারের জন্য কিছু করতে পারছি না। 

সাদা পাথর রিসোর্টের সহকারী ব্যবস্থাপক জুয়েল রানা জানান, ‘ঈদের আগেই আমাদের রিসোর্টে অগ্রীম কিছু বুকিং ছিল। ঈদের দিন থেকে বন্যা শুরু হলে সব বুকিং বাতিল হয়ে যায়। বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর আরও কিছু বুকিং হয়েছিল কিন্তু দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে সেগুলোও বাতিল হয়েছে। গত কয়েক দিন কোনো পর্যটকের মুখও দেখছি না আমরা। স্টাফদের বেতনভাতাসহ নানা খরচ থেমে নেই। পর্যটক না আসায় আমাদের মাসিক লাখ লাখ টাকার ক্ষতির হিসাব করতে হচ্ছে। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমাদের ব্যবসা আবারও চাঙ্গা হবে বলে আশা করছি। 

কোম্পানীগঞ্জ ফটোগ্রাফি সোসাসাইটির সভাপতি মো. শরীফ আহমদ সিলেট মিররকে বলেন, পর্যটকদের ছবি তুলে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন এখানের শতাধিক ফটোগ্রাফার। পর্যটকদের ছবি তুলে দৈনিক দেড়-দুই হাজার টাকা ইনকাম করেন ফটোগ্রাফাররা। কিন্তু গেল এক মাসের অধিক সময় ধরে পর্যটকদের আনাগোনা কমে যাওয়ায় ফটোগ্রাফাররা বেকারত্বের বোঝা কাধে নেওয়ার অবস্থায় আছেন। দেশের বর্তমান অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা চরম অসহায় হয়ে পড়বে। 




এএফ/০৩