বড়লেখায় সক্রিয় প্রতারক চক্র, টার্গেট শিক্ষার্থীরা

এ জে লাভলু, বড়লেখা


মে ০৭, ২০২০
১১:১২ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০৭, ২০২০
১১:১৩ অপরাহ্ন



বড়লেখায় সক্রিয় প্রতারক চক্র, টার্গেট শিক্ষার্থীরা
উপবৃত্তি দেওয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদ

‘হ্যালো, আমি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলছি। তোমার নাম কি রুমা (ছদ্মনাম)? তুমি বড়লেখা নারীশিক্ষা কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী? তোমার বাবার নাম জব্বার মিয়া (ছদ্মনাম)?' ওই শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি বলেন, ‘তোমার (রুমা) উপবৃত্তির ১০ হাজার ২শ টাকা আমার কাছে আছে। তুমি একটি বিকাশ নম্বর দাও। সেটিতে একটি পিন নম্বর যাবে। সেই পিন নম্বরটি তুমি আমাকে দিলে আমি টাকাটা পাঠিয়ে দেব।’

এভাবেই নিজেকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়ে এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে মুঠোফোনের মাধ্যমে (০১৮৮৯৪৬৮১৬৬ ও ০১৮৮৮৫৩৩৯৯২) কথা বলে বিকাশ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্রতারক চক্রের এক সদস্য। ওই চক্রটি গত কয়েকদিনে মৌলভীবাজারের বড়লেখা নারীশিক্ষা একাডেমি এন্ড ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে মুঠোফোনে উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার নামে উল্টো টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরই মধ্যে চক্রটি এক শিক্ষার্থীর ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর কারও কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিলেও ভুক্তভোগীরা লজ্জায় তা প্রকাশ করছেন না। এ অবস্থায় চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। এতে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এদিকে প্রশ্ন উঠেছে, ওই প্রতারক চক্রটি কিভাবে শিক্ষার্থীদের নাম-পরিচয় ও ফোন নম্বর পেয়েছে? কারণ উপবৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীরা রকেট বা বিকাশ (মোবাইল ব্যাংকিংয়ের) মাধ্যমে নিজেদের মুঠোফোনে পেয়ে থাকেন। আর শিক্ষার্থীরা রকেট বা বিকাশ একাউন্ট খুলেছেন তাদের কলেজে। সে হিসেবে এসব তথ্য একমাত্র কলেজ কর্তৃপক্ষ আর উপবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ছাড়া কারও জানার কথা নয়।   

কলেজ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বড়লেখা নারীশিক্ষা একডেমি এন্ড ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিবছর জনপ্রতি উপবৃত্তির টাকা হিসেবে ৪ হাজার ৯শ টাকা পান। তারা এই টাকা রকেট বা বিকাশের (মোবাইল ব্যাংকিং) মাধ্যমে নিজেদের মুঠোফোনে পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তাদের আগে রকেট বা বিকাশ একাউন্ট খুলে নাম-পরিচয় ও মুঠোফোন নম্বর প্রদান করতে হয়। আর এসব তথ্য একমাত্র তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আর উপবৃত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে।

গত কয়েকদিন থেকে একটি প্রতারক চক্র ওই কলেজের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার কথা বলে তাদের মুঠোফোনে কল করে তাদের কাছ থেকে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চক্রের সদস্যরা প্রথমে শিক্ষার্থীদের কল দিয়ে নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়। এরপর তাদের একটি বিকাশ নম্বর দিতে বলে। আর যাদের পারসোনাল (ব্যক্তিগত) বিকাশ নম্বর নেই, তাদের কাছে নিকটস্থ কোনো বিকাশ এজেন্টের নম্বর চেয়ে থাকে। যারা বিকাশ নম্বর দেন, তাদের মুঠোফোনে একটি পিন নম্বর  আসে। যে পিন নম্বরটি আসে সেটি তাদের (প্রতারক) জানাতে বলা হয়। যেসব শিক্ষার্থী সরল বিশ্বাসে ওই পিন নম্বরটি জানান, মূলত তাদের বিকাশে থাকা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। এর মধ্যে এক শিক্ষার্থীর ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্রটি। অন্য শিক্ষার্থীরা বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দেননি।  

নারীশিক্ষা একাডেমি এন্ড ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রুমা (ছদ্মনাম) আজ বৃহস্পতিবার (৭ মে) বলেন, আমাকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি কল করেন। প্রথমে তিনি হুবহু আমার নাম-পরিচয় বলেন। তিনি আমার পরিচয় যখন নিশ্চিত হন, তখন জানান তার কাছে আমার উপবৃত্তির ১০ হাজার ২শ টাকা রয়েছে। একটি বিকাশ নম্বর দিলে তিনি তা পাঠিয়ে দেবেন। আমরা বিকাশ নম্বর দেওয়ার পর সেটিতে একটি পিন নম্বর আসবে। সেটি দিলেই আমি টাকাটা পেয়ে যাব। আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে আমার ভাইকে জানাই। তিনি প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন। পরে তারা (প্রতারক) আর যোগাযোগ করেনি।

ওই কলেজের তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমাকে এক ব্যক্তি কল করেন। প্রথমে তিনি আমার নাম-পরিচয় বলেন। আমি প্রথমে ভেবেছি তিনি হয়তো আমার কলেজের কোনো স্যার হবেন। পরে পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের এক কর্মকর্তা তিনি। পরে তিনি বলেন, তোমার উপবৃত্তির টাকা আমার কাছে আছে। টাকা নিতে হলে এই মুহূর্তেই আমাকে একটি বিকাশ নম্বর দিতে হবে। তবে বিষয়টি কাউকে জানাবে না। এমনকি পরিবারের কাউকেও না। আমরা ৯৫ হাজার শিক্ষার্থীকে বিকাশে টাকা দিয়েছি। তুমি তিন নম্বর সিরিয়ালে রয়েছো। আমি সত্যি মনে করে নম্বর দিতে চেয়েছিলাম, পরে কলেজের স্যারকে ফোন করে নিশ্চিত হই যে আমি প্রতারকের ফাঁদে পড়েছি। পরে আমি আর বিকাশ নম্বর দেইনি।

প্রতারণার শিকার নারীশিক্ষা একাডেমি এন্ড ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রতারকরা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে আমি যদি তাদের ২৫ হাজার টাকা বিকাশে দেই, তাহলে তারা আমাকে ৫০ হাজার টাকা দেবে। এটা উপবৃত্তির টাকা। তবে বিষয়টি যেন কাউকে না জানাই। পরে আমিও কাউকে এটা জানাইনি। বিশ্বাস করে তাদের দেওয়া একটি নম্বরে ২৫ হাজার টাকা বিকাশ করেছি। পরে দেখি তাদের সেই নম্বরটা বন্ধ। পরে তারা আর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জাহাঙ্গীর আলম বৃহস্পতিবার বলেন, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে আমার বোনকে এক প্রতারক কল দেয়। বলে তারা উপবৃত্তির টাকা দেবে। এ জন্য একটি বিকাশ নম্বর দিতে হবে। পরে আমার বোন আমার বিকাশ নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে। আমি বিষয়টি বুঝতে পারায় প্রতারক চক্রটি আর ফোন করেনি।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তির টাকা সরাসরি রকেট আর বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। আর এসব একাউন্ট কলেজ কর্তৃপক্ষ খুলে দিয়েছে। এসব তথ্য কলেজ কর্তৃপক্ষসহ এর সঙ্গে যারা জড়িত তারা ছাড়া আর কারও জানার কথা নয়। কিন্তু এসব তথ্য প্রতারক চক্র কিভাবে পেল?

নারীশিক্ষা একাডেমি এন্ড ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক হাসান আহমদ বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, একটি প্রতারক চক্র শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ার কথা বলে উল্টো বিকাশ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষার্থীরা বিষয়টি ফোনে জানাচ্ছে। এ পর্যন্ত অর্ধশত শিক্ষার্থীকে তারা ফোন করেছে। আমরা শিক্ষার্থীদের সতর্ক করছি। ইতোমধ্যে এক শিক্ষার্থীর ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। ওই শিক্ষার্থীকে থানায় অভিযোগ দিতে বলেছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ হারুন-উর-রশীদ বলেন, একটি চক্র শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উপবৃত্তির অর্থ দেওয়ার নামে উল্টো টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ইতোমধ্যে ২৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে শুনেছি। চক্রটি যেসব শিক্ষার্থীদের ফোন দিচ্ছে, আমরা তাদের সতর্ক করছি, পাশাপাশি থানায় অভিযোগ দিতে বলেছি।

এ ব্যাপারে বড়লেখা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক বলেন, এ বিষয়ে কেউ এখনও কোনো অভিযোগ করেনি। কেউ যদি অভিযোগ করেন, তবে আমরা বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।  

 

এজে/আরআর