ফারহান মাসউদ আফছর, গোলাপগঞ্জ
জুন ২০, ২০২০
০৫:০৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুন ২০, ২০২০
০৫:০৪ পূর্বাহ্ন
২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের গোলাপগঞ্জে এসেছিলেন। গোলাপগঞ্জ এমসি একাডেমী মাঠে স্মরণকালের বৃহত্তর জনসভায় আসেন তিনি। লোকে লোকারণ্য পুরো মাঠ, সড়ক, ফুটপাত, বাড়ির ছাদ, গাছের ডাল। সর্বত্র মানুষে ঠাসা। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে উপস্থিত। উচ্ছ্বসিত, উৎফুল্ল নেতাকর্মী, সমর্থকদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত স্লোগান, মঞ্চের দিকে ধাবমান লক্ষ জনতার চাপ।
হঠাৎ মাইকে বেজে উঠলো ভরা কন্ঠের আওয়াজ। সকলের মনোযোগ গেলো মঞ্চের দিকে। মাইক্রোফোনে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ভরাট কন্ঠে বলে উঠলেন- 'মাননীয় নেত্রী, গোলাপগঞ্জের এই মাঠ সিলেটের আলিয়া মাদরাসার মাঠের চেয়ে আড়াই গুন বড়। সেই মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে লোকসমাগম ছাড়িয়ে গেছে রাস্তা, ফুটপাত, বাড়ির ছাদ পর্যন্ত। আপনাকে ভালোবেসে, নৌকাকে ভালোবেসে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন সর্বস্তরের মানুষ।' উপস্থিত জনতা তখন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে মুহুর্মুহু করতালিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তোলেন।
গত ১৪ জুন দিবাগত মধ্যরাতে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। পুরো সিলেটের মতো গোলাপগঞ্জের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ তাকে এখন নানা স্মৃতিচারণের মাধ্যমে স্মরণ করছেন। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান কারও কাছে জনতার কামরান, কারও কাছে মানবতার কামরান আর কারও কাছে সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের কামরান। সিলেট সিটি করপোরেশনের দুইবারের নির্বাচিত মেয়র, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য বদর উদ্দিন আহমদ কামরান দলীয় ও সামাজিক সকল কার্যক্রমে ছিলেন স্বতঃস্ফুর্ত। সিলেটের যেকোনো প্রান্তের মতো গোলাপগঞ্জে আওয়ামী লীগের যেকোনো দলীয় কার্যক্রমে বদরউদ্দিন আহমদ ছিলেন সবচেয়ে পরিচিত মুখ। ইউনিয়ন নির্বাচন থেকে শুরু করে পৌর, উপজেলা বা জাতীয় নির্বাচন সব জায়গায় বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের উপস্থিতি ছিল অবশ্যম্ভাবী।
গোলাপঞ্জবাসীর জন্য ঐতিহাসিক ওই দিনটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের বুদ্ধিদিপ্ত বক্তব্যের কথা গোলাপগঞ্জ উপজেলার নেতাকর্মীদের মুখে এখনও শুনতে পাওয়া যায়। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী রিংকু বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর সেই বিশাল জনসভার মঞ্চে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। দেখেছি জননেতা বদরউদ্দিন কামরান তার সহজাত রাজনৈতিক দক্ষতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সেদিনের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সভার সৌন্দর্য ফিরিয়ে এনেছিলেন এক আকর্ষণীয় বক্তব্যের মাধ্যমে। তিনি সিলেটের রাজনীতির ইতিহাসে একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বেঁচে থাকবেন। সর্বাবস্থায় যেকোনো প্রয়োজনে তাঁর স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ শুধু রাজনীতিবিদদের জন্য নয়, আমাদের সকলের জন্য অনুকরণীয়।'
উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক রুহেল বলেন, 'কামরান ভাই ছিলেন অসাধারণ সম্মোহনী শক্তির অধিকারী। আমার ছাত্র রাজনীতির সময় থেকে কামরান ভাইয়ের বিচরণ দেখতে পাচ্ছি।' তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গোলাপগঞ্জ আগমনের কথা স্মরণ করে বলেন, 'সেদিন এক উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছিল গোলাপগঞ্জ। সড়কে সড়কে দীর্ঘ লাইনে হেঁটেছে মানুষ। দোকান-হোটেলে লাইন দিয়ে প্রবেশ করতে হয়েছে। সড়কে দূর-দূরান্ত থেকে আসা গাড়ির সারি। সভাস্থল এমসি একাডেমী মাঠের কথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কানায় কানায় পূর্ণ ছিল মাঠ। জনতার ঢল উপচে পড়েছে পাশের সড়ক, বাসা-বাড়ি বা সুরমা নদীর পাড় সর্বত্র। বিশাল সমাবেশে বিক্ষিপ্ত স্লোগান, শোরগোল থাকায় সাধারণ মানুষের মনোযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। কামরান ভাই তার মুহূর্তের বুদ্ধিদিপ্ত বক্তব্যে সবার মনোযোগ মঞ্চের দিকে নিয়ে যান। এ ধরনের লক্ষ জনতার জনসভায় মঞ্চের দিকে মনোযোগ আনার ক্ষমতা খুব কম নেতার থাকে। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান যখন বললেন, 'আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) ভালোবেসে, নৌকাকে ভালোবেসে মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছেন,' তখন পুরো জনসভাস্থল হাততালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।'
বাদেপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ বলেন, 'কামরান ভাই গোলাপগঞ্জে ছিলেন একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ,সভা-সমাবেশ, নির্বাচনী গণসংযোগে কামরান ভাইয়ের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে জয়ী করতে তার চেষ্টা ছিল নিরলস। বিগত ইউপি নির্বাচনে আমার নির্বাচনী জনসভায় উপস্থিত ছিলেন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, 'মোস্তাকের পিতা নেই, আমি তার পিতা, অভিভাবকতূল্য। আপনারা তাকে ভোট দিন, আমি কথা দিচ্ছি- সে আপনাদের সর্বোচ্চ সেবা দেবে।' সেদিন অনেকেই মঞ্চে ছিলেন, কিন্তু আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মীর জন্য হাজারও মানুষের সামনে একমাত্র কামরান ভাই অভিভাবকের দ্বায়িত্ব নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মানুষের কাছে ভোট প্রার্থনা করেছিলেন।'
কথা হয় গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার ইউনুছ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে গোলাপগঞ্জের প্রত্যেকটি নির্বাচনী সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগে উপস্থিত থেকে নিউজ কাভার করার সুযোগ হয়েছে। যেখানেই গেছি, কামরান ভাইয়ের উপস্থিতি ছিল অবধারিত, সপ্রতিভ। গোলাপগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর সেই ঐতিহাসিক জনসভার কথা আমার মনে এখনও নাড়া দেয়। ঐতিহাসিক জনসভার মঞ্চের ঠিক সামনে থেকে নিউজ কাভার করছিলাম। বিশাল সমাবেশে ছিল স্লোগান, শোরগোল। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান তাঁর অসাধারণ বক্তব্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। গোলাপগঞ্জে তিনি অসংখ্যবার এসেছেন। কিন্তু সেদিনের বিষয়টি ছিল অন্য সবগুলো থেকে আলাদা।'
গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী বলেন, 'বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন আপামর জনগণের নেতা। তিনি মাঠ পর্যায় থেকে রাজনীতি করেছেন। তিনি সবসময় দায়িত্ববোধ নিয়ে রাজনীতি করতেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি জনগনের জন্য কাজ করে গেছেন। গোলাপগঞ্জের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে তিনি বিগতদিনের ইউনিয়ন নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে চষে বেড়িয়েছিলেন।'
কিছুদিন আগের একটি ঘটনা তার মনকে এখনও নাড়া দিচ্ছে জানিয়ে ইকবাল আহমদ চৌধুরী জানান, করোনা প্রাদুর্ভাবের আগ মুহূর্তে একদিন তিনি সেলুনে গেছেন চুল কাটাতে। সেখানে তখন চুল কাটতে বসেছেন কামরান। তাকে দেখেই কামরান উঠে যান এবং তাকে আগে চুল কাটার সুযোগ করে দেন। কামরান এরকম শিষ্টাচার নিয়ে তিনি চলতেন। সবসময় বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা তাঁর স্বভাবজাত আচরণ ছিল।
স্মৃতিচারণে এডভোকেট ইকবাল আহমদ চৌধুরী আরও বলেন, 'কামরানের মধ্যে একটা সম্মোহনী শক্তি ছিল, যা দিয়ে সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারতেন। তাঁর এই আকস্মিক চলে যাওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক। এটি আমাদের জন্য এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।'
এফএম/আরআর-০৫