বাস আছে, যাত্রী নেই

নাবিল চৌধুরী


জুলাই ০৭, ২০২০
০২:১৭ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ০৭, ২০২০
০৯:১৪ অপরাহ্ন



বাস আছে, যাত্রী নেই

মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে সিলেট থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন চলতো দূরপাল্লার প্রায় ৩শ বাস। আর এখন চলছে মাত্র ৫০/৬০টি। শর্ত অনুযায়ী বাসের অর্ধেক আসনে যাত্রী তোলার সুযোগ থাকলেও যাত্রী সংকটে এসব বাসের অর্ধেক আসনও পূর্ণ হচ্ছে না। তাই ভাড়া বাড়ানো সত্ত্বেও সংকটে পড়েছেন বাস মালিক ও শ্রমিকেরা।
মহামারী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশের মতো সিলেটেও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১ জুন থেকে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। বাড়ানো হয় ৬০ শতাংশ ভাড়া। কিন্তু এখনও যাত্রীবাহী বাসগুলো পর্যান্ত যাত্রী পাচ্ছে না। ‘ট্রিপ’ কমে যাওয়ায় যাত্রীবাহী বাসগুলোতে কর্মরত ড্রাইভার ও শ্রমিকদের আয়ও কমেছে।
গত রবিবার বেলা ২টায় সিলেটের কদমতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সব কাউন্টারই ফাঁকা। যাত্রীর কোনো চাপ নেই। অলস সময় পার করছেন কাউন্টারে দায়িত্বরতরা। মাঝেমধ্যে দুই একজন যাত্রী আসছেন কাউন্টারে। প্রতিটি বাসে যাত্রী তোলার সময় হাতে প্রয়োজন মতো হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া হচ্ছে। বাসের ভেতরে যাত্রীদের পাশের আসন ফাঁকা রেখে বসতে দেখা গেছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা জানান, সিলেট থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে প্রায় ৩শ বাস নিয়মিত চলাচল করে। কিন্তু এখন চলছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি। যার বেশিরভাগই যাচ্ছে ঢাকায়।
কদমতলী বাস টার্মিনালে মামুন এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে মো. সাগর নামের একজনকে টিকেট বিক্রির জন্য বসে থাকতে দেখা যায়। সিলেট মিররকে তিনি বলেন, ‘আগে প্রতিদিন সিলেট থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে মামুন এন্টারপ্রাইজের ১২ থেকে ১৪টি বাস চলাচল করতো। এখন প্রতিদিন চলছে ৩ থেকে ৪টি বাস। আগে প্রতিটি বাসে ৪০ জন যাত্রী নেওয়া গেলেও এখন ২০ জন নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এই ২০ আসনের বিপরীতে যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে গড়ে ১২ থেকে ১৪ জন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা টিকেটের দাম খুব বেশি বাড়াইনি। আগে যেখানে ভাড়া ছিল ৪৭০ টাকা। এখন হয়েছে ৬শ টাকা। এরপরও যাত্রী মিলছে না।’ রবিবার দুপুর ১২টায় ঢাকায় ছেড়ে যাওয়া বাসে মাত্র ১৪ জন যাত্রী ছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
এমন অবস্থা জীবনে কখনও আসেনি বলে জানিয়েছেন দীর্ঘদিন বিভিন্ন পরিবহনে চালক হিসেবে কাজ করা তারিফ মিয়া। চালকেরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন ২ থেকে ৩ দিন পর একটি ট্রিপ পাই। যা দিয়ে সংসার চলে না।’ অনেক চালক গাড়ি ছেড়ে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গত রবিবার বেলা পৌনে তিনটায় হুমায়ুন রশীদ চত্বরে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে গিয়ে কয়েকজন যাত্রীকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদেরই একজন শফিক হোসেন সিলেট মিররকে বলেন, ‘আমি ঢাকায় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করি। করোনার কারণে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি চলে আসি। এই মাসে রেস্টুরেন্ট চালু হবে। তাই ঢাকায় যাচ্ছি।’
হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টারে কর্মরত সালেহ আহমদ জানান, আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২টি বাস সিলেট থেকে বিভিন্ন রুটে যেত। এখন যাচ্ছে ৫ থেকে ৭টি। বাসগুলোতে আসন আছে ৩৮টি। এখন অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে ১৮ জনের বেশি যাত্রী নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু গড়ে ১০ থেকে ১২ জনের বেশি যাত্রী মিলছে না।
তিনি বলেন, ‘এখন কেউ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঢাকা যাচ্ছে না। অনেকে বেশি ভাড়ার কারণেও বাস এড়িয়ে চলছে।’ হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাসের ভাড়া ৪৭০ টাকার জায়গায় ৭৫০ টাকা করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
হুমায়ুন রশীদ চত্বরে লন্ডন এক্সপ্রেসের কাউন্টারে কর্মরত কামাল হোসেন বলেন, ‘আগে আমাদের ৪ থেকে ৫টি বাস প্রতিদিন ঢাকায় গেলেও এখন যাচ্ছে মাত্র একটি। বাসে মাত্র ১৮ জন যাত্রী নেওয়া সম্ভব হয়। টিকেট মূল্য ১২শ টাকা থেকে ১ হাজার ৪৫০ করা হয়েছে। এরপরও প্রতিদিন মাত্র ১০ থেকে ১২ জনের বেশি যাত্রী পাচ্ছি না।’ রবিবার রাত সাড়ে ১০টার বাসের জন্য বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাত্র একটি টিকেট বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এখন কেউ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গণপরিবহনে যাচ্ছেন না। ঢাকায় পুরোদমে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু না হওয়া, বেশিরভাগ বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকার কারণেই যাত্রী মিলছে না। মহামারীর শুরুতে শিক্ষার্থী ও নি¤œবিত্তরা ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরলেও অনেকেই ঢাকা যাচ্ছেন না। তাই পর্যাপ্ত যাত্রী মিলছে না বলে মনে করেন তারা।
এদিকে, রবিবার কুমারগাঁও বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও যাত্রী সংকট। এখান থেকে সুনামগঞ্জ শহর ও দিরাই উপজেলায় বাস যায়। এই টার্মিনালের কর্মরতরা জানান, করোনার প্রভাবে যাত্রী সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। আগে প্রতি ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর পর ৪০ জন যাত্রী নিয়ে সুনামগঞ্জ শহর ও দিরাই যেত বাস। এখন ২০ জন যাত্রী পেতেও দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিলেট বিভাগীয় কমিটির সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক পরিবহন মালিক সমিতিরও নেতা। তিনি এনা পরিবহনের সিলেটের ইনচার্জ। সিলেট মিররকে ফলিক বলেন, ‘পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সিলেট থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে আগে প্রায় তিনশ বাস চলাচল করতো। এখন চলছে ৫০টির মতো। বাস চলাচল কমে যাওয়ায় শ্রমিকেরা কম টাকা পাচ্ছেন। কারণ তারা চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন।’
এনা পরিবহনের ৪২ থেকে ৪৯টি বাস প্রতিদিন সিলেট থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে যেত। এখন যাচ্ছে মাত্র ৮ থেকে ১২টি। প্রতিটি বাসে ১৮ আসনের বিপরীতে মাত্র ১০ থেকে ১২ জন যাত্রী মিলছে বলে জানিয়েছেন সেলিম আহমদ ফলিক।
এনপি-০২