বিদ্যালয়ের অফিস সহকারীর আত্মহত্যায় বিশ্বনাথে তোলপাড়

মোহাম্মদ আলী শিপন, বিশ্বনাথ


জুলাই ১৫, ২০২০
০৬:৫৮ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১৫, ২০২০
০৬:৫৮ অপরাহ্ন



বিদ্যালয়ের অফিস সহকারীর আত্মহত্যায় বিশ্বনাথে তোলপাড়

আসমা শিকদার সিমলা

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলার (৪০) হারপিক খেয়ে আত্মহত্যার ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে আসমার পিতা ও স্বামীর বাড়ির লোকজন এবং স্কুল কমিটির নেতৃবৃন্দ করছেন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। আবার আসল ঘটনাকে আড়াল করে তৃতীয় একটি পক্ষ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে স্কুল ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

আসমার আত্মহত্যার পর তার স্বামী দৌলতপুর ইউনিয়নের বাহাড় দুভাগ গ্রামের ফজলুর রহমান বাদী হয়ে স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি, একজন সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ৭ জনকে অজ্ঞাতনামা অভিযুক্ত করে থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- স্কুল গভর্নিং বডির সভাপতি দৌলতপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এম এ রউফ (৬৫), সদস্য আনোয়ার মিয়া (৪৫) ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চরশ্রীরামপুর গ্রামের হাসিম উদ্দিন (৬০)। তাদের মধ্যে আনোয়ার মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

আসমার পিতা ও স্বামীর পরিবারের দাবী, আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের বিগত ৩ বছরের হিসাব দেওয়ার জন্য গত ১৮ জুন গঠিত প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে একাধিকবার চাপ প্রয়োগ ও অপমান করেন। এমনকি নিজেদের পছন্দের মানুষকে চাকরি দেওয়ার জন্য কলেজ শাখার অফিস সহকারীর পদ থেকে আসমাকে বাদ দেওয়া হয়। আর এসব অপমান সহ্য করতে না পেরে গত ৬ জুলাই নিজের ভাড়া বাসার বাথরুমে আত্মহত্যার উদ্দেশে হারপিক পান করেন তিনি। এরপর সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ জুলাই ভোররাতে আসমা মৃত্যুবরণ করেন।

স্কুল কমিটির দাবি, পারিবারিক কলহের জের ধরে প্রায় ১০ মাস পূর্বে স্বামী-সন্তানসহ আসমাকে নিজ বাড়ি থেকে বের করে দেন তার (আসমা) দেবর ও স্থানীয় ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য তালুকদার শাহীন আহমদ। গত ঈদের দিন আসমা স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড়িতে গেলে তাদেরকে অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেন শাহীন, যা আসমা নিজ মুখে গভর্নিং বডির অনেককে বলেছেন। আর পারিবারিক কলহ চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকার কারণে মৃত্যুর পরও স্বামীর বাড়ির কবরস্থানে আসমার লাশ দাফন করা হয়নি, দাফন করা হয়েছে পিতার বাড়ির কবরস্থানে। আর বিধিমতে প্রতিষ্ঠানের হিসাব সাবেক কমিটি বর্তমান কমিটির কাছে হস্তান্তর করবে। এখানে অফিস সহকারীর কাছে হিসাব চাওয়া অযৌক্তিক ও অবৈধ। যদি গভর্নিং বডির নেতৃবৃন্দ আসমার সঙ্গে বার বার ওই অবৈধ ও অযৌক্তিক কাজ করে থাকেন, তা হলে তিনি (আসমা) কেন বিষয়টি তার দেবর (শাহীন) ও স্থানীয় মেম্বার বা চেয়ারম্যান বা এলাকার গণ্যমান্য বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বা ইউএনও’র কাছে অভিযোগ অথবা তাদেরকে অবহিত করলেন না। তারা স্বামী-স্ত্রী (ফজলুর-আসমা) ছাড়া প্রতিষ্ঠানের হিসাবের জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে আর কেউ জানেন না।

   

তবে আসমার স্বামী ফজলুর রহমান বলেন, 'আমাদের পারিবারিক কোনো কলহ নেই। স্কুলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছি। আমার ভাই কর্তৃক বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগটি মিথ্যা, বানোয়াট। আসমা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের একটি দুর্নীতি ধরিয়ে দিলেও গভর্নিং বডি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়নি। বরং আমার সামনেই গভর্নিং বডির সদস্য আনোয়ার আসমাকে চড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন এবং হিসাব ঠিক না থাকলে তার পিতার গলায় চাপ দিয়ে টাকা উদ্ধার করার হুমকি দেন সভাপতি। অধ্যক্ষের দুর্নীতি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য আসমাকে কলেজ শাখার অফিস সহকারীর পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। আমরা চেয়েছিলাম বাইরের কাউকে না জানিয়ে বিষয়টি শেষ করতে। আর তাই নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য কাউকে এ ব্যাপারে জানানো হয়নি।'

স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি দল গত সোমবার (১৩ জুলাই) সরেজমিনে এলাকায় গেলে উভয়পক্ষের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পেলেও প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিম উদ্দিনের দেখা পাননি। আর এ ঘটনায় যাতে কাউকে অযথা হয়রানি করা না হয় সেজন্য প্রশাসন ও সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য কর্তৃক অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে অবৈধভাবে হিসাব দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে তার (আসমা) মৃত্যুর পূর্বে জানতেন না বা জানানো হয়নি বলে স্বীকার করেছেন আসমার দেবর ও স্থানীয় ইউপি সদস্য তালুকদার শাহীন আহমদ এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছোট ভাই স্বপন শিকদার। সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীর শাস্তি দাবি করেছেন তারা।

এদিকে বিদ্যালয়ের নবগঠিত কমিটির ৩ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, 'প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন ৪/৫ বার তাদের (আসমা ও ফজলুর) সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু কোনোদিনই তাদের মুখে প্রতিষ্ঠানের হিসাবের জন্য নতুন কমিটির সদস্য কর্তৃক আসমাকে অবৈধ চাপ প্রয়োগের কথা শুনিনি। আসমার আত্মহত্যা করার আসল রহস্য উদঘাটন হওয়া জরুরি।'

আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা এম এ রউফ বলেন, 'আসমা আমার মেয়ের মতো হওয়ায় সে প্রায়ই নিজের পারিবারিক কলহের কথা আমাকে বলত। নিজেও মানসিক চাপে ভুগতো। তাই আমি তাকে নিজের সাধ্যমতো সান্ত্বনা দিতাম। প্রতিষ্ঠানের হিসাব তার কাছে যাওয়া বা এজন্য তাকে চাপ দেওয়া একটি অবৈধ কাজ। আর আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো অবৈধ কাজ করতে পারি না। পূর্বের কমিটি আমাদের কাছে ৪ বছরের হিসাব হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন। আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য ৬ সদস্য বিশিস্ট একটি অডিট কমিটি গঠন করে তদন্ত করাচ্ছি। তাহলে আসমাকে কিভাবে চাপ দিলাম? আসমার আত্মহত্যার জন্য তার স্বামী ফজলুর দায়ী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে। আর সে (ফজলুর) নিজেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট মামলা করেছে। এছাড়া একটি পক্ষ তাকে ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা করছে। তাছাড়া শুনেছি পারিবারিক কলহের কারণে ইতোপূর্বে আরও দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন আসমা।'

এ ব্যাপারে গ্রেপ্তারকৃত আনোয়ার মিয়ার স্ত্রী সুরমা আক্তার শিবলী বলেন, 'আমার স্বামী তার (আসমা) সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে কি আর স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি (আসমা) আমাদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে (গত ৩ জুলাই) আসতেন। পারিবারিক কলহের জের ধরেই আসমা আত্মহত্যা করেছেন। আর তার স্বামী নিজেকে বাঁচাতেই স্কুল কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।'

বিশ্বনাথ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম মুসা বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে পুলিশের তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আর সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় কাউকে হয়রানি করা হবে না।'

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. কামরুজামান ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সমীর কান্তি দেব বলেন, 'প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য কর্তৃক অফিস সহকারী আসমা শিকদার সিমলাকে অবৈধভাবে হিসাব দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে তার (আসমা) মৃত্যুর পূর্বে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। এমনকি অবহিতও করেননি।'

 

এমএ/আরআর-০১