আজ সুরীকোণা গণহত্যা দিবস : জোটেনি সরকারি স্বীকৃতি

উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর


জুলাই ১৯, ২০২০
১০:১৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুলাই ১৯, ২০২০
১০:১৪ পূর্বাহ্ন



আজ সুরীকোণা গণহত্যা দিবস : জোটেনি সরকারি স্বীকৃতি

সুরীকোণার এই স্থানেই ঘটেছিল গণহত্যার ঘটনা।

আজ ১৯ জুলাই সিলেটের ওসমানীনগরের সুরীকোণা গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন এ এলাকার অর্ধশত মানুষ। ক্ষরণের সে আখ্যান ঠাঁই করে নিয়েছে ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাসে। তাই সুরীকোণা গণহত্যার করুণ কাহিনী অনেকের কাছেই অজ্ঞাত। এমনকি এখন পর্যন্ত সরকারি স্বীকৃতিটুকুও জোটেনি সেদিনের শহীদদের ভাগ্যে।

১৮ জুলাই ১৯৭১। যুদ্ধের ডামাঢোলেও থেমে ছিল না সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। তিনদিকে নদীবেষ্টিত সাদীপুর ইউনিয়নের সুরীকোণা গ্রাম। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন পাক হায়েনাদের থেকে প্রাণে বাঁচতে এ গ্রামে আশ্রয় নেন। সেদিন রাতে ছিল গ্রামের জনৈক হারিছ আলীর মেয়ের বিয়ে। প্রথা অনুযায়ী তখন বিয়ের আয়োজন হতো রাতে। বিয়ে উপলক্ষে ব্যাপক লোকসমাগমও হয়। প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের শেরপুর পাকিস্তানি ক্যাম্পে খবর আসে সুরীকোণায় মুক্তিবাহিনী আশ্রয় নিয়েছে এবং হারিছ আলীর বাড়ি থেকে মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার দেওয়া হয়েছে। এ সংবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দখলদার বাহিনী। রাত ৩টার দিকে দু'টো লঞ্চযোগে শতাধিক পাকসেনা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় সুরীকোণা গ্রাম ঘেরাও করে।

১৯ জুলাই ভোরে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে হানা দেয় তারা। পুরুষদের ঘুম থেকে ডেকে এনে ‘মুক্তি’ বলে নদীপাড়ে একাধিক সারিতে দাঁড় করানো হয়। গ্রামের উত্তরে নাটকিলা নদীর পাড়ে এক সারি, দক্ষিণ-পশ্চিমে কুশিয়ারা নদীর পাড়ে আরও দুই সারি পুরুষ। সবমিলিয়ে গ্রামের প্রায় ৩০ জন ও অন্যান্য এলাকা থেকে ধরে আনা আরও প্রায় ২০ জন ছিলেন। পাকবাহিনী প্রথমে সবাইকে কলেমা পড়তে বলে। কলেমা পড়া শেষ হলে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে তারা। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নাটকিলা ও কুশিয়ারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুহূর্তেই নদীর পানি রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করে। আহাজারীতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। গ্রামের নারীরা প্রাণ ও সম্মান বাঁচাতে লুকিয়ে পড়েন। ঘন্টাব্যাপী পাকবাহিনীর তাণ্ডবে এলোমেলো হয়ে পড়ে পুরো গ্রাম। গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই মৃত্যুর ভান করে বেঁচে যান মানিক মিয়া, আতাউর রহমান ও শামসুল হক। পরবর্তী সময়ে এলাকার লোকজন নদী থেকে ৩৪ জন শহীদের লাশ উদ্ধার করে গণকবর দেন। বাকি লাশগুলো পানিতে ভেসে যায়।

সেদিনের শহীদ হিসেবে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন- মকরম উল্যা, মুহিব উল্যা, জহির উল্যা, আব্দুল বাহার, সুরুজ উল্যা, আব্দুল জব্বার, সাজিদ উল্যা, আফিজ উল্যা, সাইদুর রহমান, হেকিম উল্যা, ইউনুস উল্যা, তছই উল্যা, রমজান উল্যা, ছাদ উদ্দিন, বাহার উদ্দিন, সিরাজ উদ্দিন, খতিব উল্যা, তাহির উল্যা, আরফান উল্যা, তছদ্দর উল্যা, আগন উল্যা, আকবর উল্যা, জাহির উল্যা, আব্দুল কাহার, সাজিদ আলী, আফিজ আলী, সামছুল হক, আব্দুল হেকিম ও ইউনুছ উল্যা। অনেক লাশ নদীতে ভেসে যাওয়ায় তাদের পরিচয় জানা যায়নি।

১৯৮০ সালের দিকে কুশিয়ারা নদীর ভাঙনের শিকার হয় সুরীকোণা গ্রাম। ওইসময় গণকবর নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। ১৯৯০ সালে ভাঙনকবলিত এলাকায় আবার চর জেগে ওঠে। কবরগুলোর কোনো চিহ্ন না থাকলেও গ্রামবাসী ওই স্থানটির মাটি সামান্য উঁচু করে রেখেছেন। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কেউ সুরীকোণা গ্রামের শহীদদের খবর নিতে আসেননি। এমনকি দীর্ঘ অবহেলায় গ্রামের অনেকেই ভুলে গেছে গণহত্যার তারিখটিও। হতদরিদ্র দিনমজুর ও কৃষক পরিবারগুলো শহীদদের নাম বলতে পারে না। সুরীকোণা গ্রামে নেই গণকবর বা স্মৃতিস্তম্ভ।

গণহত্যার স্থল থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মরক্ষাকারী শামছুল হক বলেন, 'চোখের সামনে পিতা ও ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছে পাকবাহিনী। তাদের শক্তির কাছে আমরা ছিলাম অসহায়। প্রায় অর্ধশত লোক গণহত্যার শিকার হলেও বধ্যভূমির স্মৃতিরক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি সুরীকোণা গণহত্যার বিষয়টি সরকারি দলিল-দস্তাবেজেও নেই।'

সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার আফতাব আহমদ বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে এ এলাকার গণহত্যা নিয়ে আমি কাজ করছি। ইতোমধ্যে কয়েকজন শহীদের নাম পাওয়া গেছে।'

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'সুরীকোণা গ্রামের গণহত্যার স্থান হয়নি ইতিহাসের পাতায়। প্রকৃত ঘটনা অনেকেই জানে না। এমনকি বধ্যভূমি রক্ষায়ও সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই।' বর্তমান সরকারের প্রতি সুরীকোণা গণহত্যার স্বীকৃতি ও গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তিনি।

 

ইউডি/আরআর-০১