অ্যাম্বুলেন্সে শিশুর মৃত্যু : ২ বছরেও হয়নি অভিযোগ গঠন

এ.জে লাভলু, বড়লেখা


নভেম্বর ০৩, ২০২০
১০:৩৭ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ০৩, ২০২০
১০:৩৭ অপরাহ্ন



অ্যাম্বুলেন্সে শিশুর মৃত্যু : ২ বছরেও হয়নি অভিযোগ গঠন

দেশব্যাপী আলোচিত পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ৪৮ ঘন্টার ধর্মঘট চলাকালে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় ৭ দিন বয়সী এক কন্যাশিশুর মৃত্যুর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও অভিযোগ গঠন হয়নি। গত বুধবার ওই শিশুর মৃত্যুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। গতবছরের ৩০ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বড়লেখা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজস্ট্রেট আদালতের হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ১৮ মাস। অথচ আসামিদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত অভিযোগ গঠন হয়নি। ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর নির্মম ওই ঘটনাটি ঘটেছিল। 

এই মামলার আসামিরা হলেন- শ্রমিক দেলোয়ার হোসেন (৩৪), মো. আলী হোসেন (৩৮), নিজাম উদ্দিন (৩৫), কয়েছ আহমদ (২৮), আলীম উদ্দিন (৪৮), মো. জাকির হোসেন রাজন (২৪), রয়নুল ইসলাম (২৭), জসিম (৩০), হেলাল উদ্দিন (২৮), ফজল আলী (২৫), শামীম (৩৫), শরফ উদ্দিন (৩৫) ও জুয়েল দাস (২০)। তাদের বাড়ি বড়লেখা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বলে জানা গেছে। ঘটনার পর থেকে অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি রয়নুল ইসলাম, ফজল আলী, শরফ উদ্দিন ও জুয়েল দাস পলাতক রয়েছেন। বাকি ৯ আসামি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।

এদিকে দুই বছরেও বিচারকার্য শেষ না হওয়ায় নিহত শিশুর চাচা মামলার বাদী আকবর আলী হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি সিলেট মিররকে বলেন, 'ঘটনার পর আমি বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের ১৬০ থেকে ১৭০ জন শ্রমিককে আসামি করে থানায় মামলা করেছিলাম। ঘটনার তদন্ত শেষে প্রায় ৪ মাস পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত বুধবার আমার ভাতিজির মৃত্যুর দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ এখনও আমরা বিচার পাইনি।'

বড়লেখা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজস্ট্রেট আদালতের এপিপি গোপাল দত্ত সোমবার দুপুরে বলেন, 'গত বছরের ৩০ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার ১৩ আসামির মধ্যে ৯ জন উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি ৪ আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন। এই ৪ জন আদালতে হাজির না হওয়ায় অভিযোগ গঠন করতে দেরি হচ্ছে। আদালত পলাতক ৪ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আদালত মামলার পরবর্তী তারিখ ২০ ডিসেম্বর ধার্য করেছেন।'

মামলার বিবরণ ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর উপজেলার সদর ইউনিয়নের অজমির গ্রামের কুটন মিয়ার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে ওইদিন সকালে তাকে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। শিশুর অভিভাবকরা অ্যাম্বুলেন্সে করে সকাল ১০টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা হন। যাওয়ার পথে বড়লেখা উপজেলার পুরাতন বড়লেখা বাজার, দাসেরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে অ্যাম্বুলেন্সটি পরিবহন শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্সটি চান্দগ্রাম নামক স্থানে গেলে পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি আটকে চালককে মারধর করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা সেখানে অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখা হয়। অ্যাম্বুলেন্স আটক থাকা অবস্থায় এর ভেতরে থাকা শিশুটি মারা যায়। দুপুর দেড়টার দিকে গাড়িটি ছাড়া পেলে শিশুটিকে পার্শ্ববর্তী সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।

নির্মম এ ঘটনার সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সারাদেশে শুরু হয় তোলপাড়। ঝড় ওঠে নিন্দার। ঘটনার সঙ্গে জড়িত পরিবহন শ্রমিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। এই ঘটনার ৩ দিন পর ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর শিশুর চাচা আকবর আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের ১৬০ থেকে ১৭০ জন শ্রমিককে আসামি করে থানায় একটি মামলা (নং-১৮) করেন। শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। এরপর ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারির মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) ওই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় তথ্য আদালতে প্রতিবেদন আকারে দাখিল করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বড়লেখা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসীম সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে শিশুটির লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত ও ময়নাতদন্তের জন্য ওই শিশুর লাশ কবর থেকে উত্তোলনের জন্য ওই বছরের ৫ নভেম্বর বড়লেখা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে আবেদন করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ নভেম্বর আদালত এক আদেশে শিশুটির লাশ কবর থেকে উত্তোলনের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিজ্ঞ জেলা হাকিম মৌলভীবাজারকে বলেন। আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বড়লেখার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী হাকিম শরীফ উদ্দিনকে লাশ উত্তোলনের সময় উপস্থিত থাকার জন্য নিয়োগ করা হয়। এরপর সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত ও ময়নাতদন্তের জন্য ৬ ডিসেম্বর ওই শিশুর লাশ কবর থেকে তোলা হয়। মামলাটি তদন্ত শেষে প্রায় ৪ মাস পর গতবছরের ৩০ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

 

এজে/আরআর-১৪