শুয়াইব হাসান
আগস্ট ০৭, ২০২১
০৪:৩০ অপরাহ্ন
আপডেট : আগস্ট ০৭, ২০২১
০৪:৩০ অপরাহ্ন
সিলেটে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে হঠাৎ করে অক্সিজেনের চাহিদা পাঁচ থেকে ছয়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকও দিতে পারছে না।
চাহিদার পাশাপাশি আরও কিছু কারণে সিলেটে অক্সিজেনের হাহাকার শুরু হয়েছে। মহানগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে অপ্রয়োজনে সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে মজুত করছেন। এতে সিলিন্ডার সংকট বাড়ছে। হাসপাতালগুলোরও নিজস্ব অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকট আছে।
সিলেটে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা আগের তুলনায় দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেশি সরবরাহ দিচ্ছেন। কিন্তু যে পরিমাণ চাহিদা সে তুলনায় তা অপর্যাপ্ত। জানা গেছে, মাসখানেক আগে সিলেটে ৪ থেকে ৫ হাজার কিউবিট মিটার অক্সিজেনের প্রয়োজন হতো। এখন প্রয়োজন হচ্ছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার কিউবিক মিটার।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেটে দুটি সরকারি হাসপাতাল ও কয়েকটি বেসরকারি মেডিকেল হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সংযোগ থাকলেও সংকুলান হচ্ছে না। রোগীদের জন্য সিলিন্ডারের সাহায্যে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হচ্ছে। যেসব হাসপাতালে সেন্ট্রাল লাইন নেই তারা আছেন আরও সংকটে।
গতকাল সিলেটে অক্সিজেন সরবরাহকারী চার প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে বাসাবাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিতে ভিড় করছেন। তবে, দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা ব্যক্তি পর্যায়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিচ্ছে না। কোম্পানিতে কর্মরত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, অপ্রয়োজনে কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার নিচ্ছেন বুঝতে পারলে তারা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তা সত্ত্বেও, নানা অজুহাত ও রোগীর কথা বলে কেউ কেউ কৌশলে তাদের কাছ থেকে সিলিন্ডার নিচ্ছেন।
অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ও লিনডে ছাড়াও ইসলাম এবং লিনডে’র ডিলার বিএইচডি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। এর মধ্যে বিএইচডি-তে সবচেয়ে বেশি ভিড় থাকে।
নগরের উপশহরের বাসিন্দা নাহিদ গতকাল বিকেল ৩টা থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দক্ষিণ সুরমা বাইপাস সড়কের বিএইচডি প্রাইভেট লিমিটেডের গোডাউনে। সিলিন্ডার নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোগীর অবস্থা এখন ভালো। কিন্তু কখন কী হয় তা বলা মুশকিল। এ জন্য অক্সিজেন নিয়ে রাখছি।’ একইভাবে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে একজন নারী সেখানে যান সিলিন্ডারের জন্য। একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার তার বাসায় রয়েছে। আরও একটি রিজার্ভ রাখার চিন্তা করছেন তিনি।
পৌণে ৬টার দিকে নগরের বালুচর এলাকা থেকে একটি খালি সিলিন্ডারসহ সেখানে যান আরও একটি ব্যক্তি। অক্সিজেন সিলিন্ডার একান্ত প্রয়োজন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আল হারামাইন হাসপাতাল থেকে রোগীকে নিয়ে বাসায় ফিরেছি। এখন অবস্থা অনেক ভালো। যদিও আমার বাসায় একটি সিলিন্ডার পূর্ণ আছে। পরে যদি না পাই সেই শঙ্কা থেকে খালি সিলিন্ডার নিয়ে এসেছি। আগামীকাল (আজ বৃহস্পতিবার) যদি সিলিন্ডার পাই তাতেও সমস্যা নেই।’
এ ব্যাপারে বিএইচডি’র স্বত্বাধিকারী হজরত আলী সিলেট মিররকে বলেন, ‘এক মাস ধরে সিলেটে অক্সিজেনের চাহিদা প্রকট। আগে অক্সিজেনের একটি গাড়ি এলে দুদিন চলতো। এখন সিলিন্ডার অক্সিজেনের চারটি গাড়ি প্রতিদিন আসছে। প্রতি গাড়িতে ১২০ বা তারও অধিক সিলিন্ডার থাকলেও গাড়ি থেকে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে খালি হয়ে যাচ্ছে। গোডাউনে অক্সিজেনভর্তি কোনো সিলিন্ডার এক ঘণ্টা রাখা যাচ্ছে না।’
তিনি জানান, প্রতিদিন বেসরকারি হাসপাতাল নর্থ ইস্ট মেডিকেল, নূরজাহান হাসপাতাল এবং নগর ও জেলার কয়েকটি ছোট ছোট হাসপাতালে তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করেন। প্রতিদিন এসব হাসপাতালেই সাড়ে তিনশর বেশি সিলিন্ডার প্রয়োজন হয়। তিনি এতগুলো দিতে পারেন না।
হজরত আলী বলেন, ‘যেদিন ঢাকা থেকে অক্সিজেন নিয়ে তিন বা চারটি গাড়ি আসে সেদিন সবাইকে মোটামুটি দেওয়া যায়। কিন্তু গাড়ি কম এলেই হাহাকার শুরু হয়।’
এই প্রতিষ্ঠানের পাশেই অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইসলাম’র অবস্থান। বিএইচডির মতো ইসলাম-এ ভিড় নেই। তাদের গোডাউনে অক্সিজেনভর্তি কোনো সিলিন্ডারও নেই। গোডাউনে দায়িত্বরত জাহেদ জানান, রাতে তাদের গাড়ি আসতে পারে। এর আগে তারা কাউকে অক্সিজেন দিতে পারছেন না।
সিলেটে লিকুইড ও সিলিন্ডার অক্সিজেন সরবরাহ দিয়ে থাকে স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লিমিটেড এবং লিন্ডে। স্পেক্ট্রা প্রতিদিন ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল ছাড়াও সিলেটের আরও অন্তত ৭ থেকে ৮টি হাসপাতালে অক্সিজেন দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির ডিস্ট্রিবিউশন অফিসার মো. মাসুদ হোসেন সিলেট মিররকে জানান, তারা আগে যে পরিমাণ অক্সিজেন দিতেন এখন তিনগুণ বাড়িয়েছেন। লিকুইড অক্সিজেন আগে সপ্তাহে দুই গাড়ি এলেও চলতো। প্রতি গাড়িতে ১২ হাজার কিউবিক মিটার অক্সিজেন থাকে। এখন দিনে এক থেকে দুই গাড়ি অক্সিজেন আনতে হয়। তা সত্ত্বেও হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা এতটা বেড়েছে যে প্রতিদিন লিকুইডের পাশাপাশি দেড় থেকে দুইশ সিলিন্ডার দিয়েও হাসপাতালগুলোকে সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না। হাসপাতালগুলো প্রতিদিন তিনশ থেকে চারশ সিলিন্ডার অক্সিজেনের চাহিদা দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল ছাড়াও সিলেটের বেসরকারি হাসপাতাল রাগিব রাবেয়া, নর্থ ইস্ট মেডিকেল ও ইউমেন্স মেডিকেল হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সংযোগ ও অক্সিজেন প্লান্ট রয়েছে। এসব হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেনের পাশাপাশি সিলিন্ডার সাপোর্টও প্রয়োজন হয়।
তবে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডে-এর পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ঢাকা অফিসের তথ্য কর্মকর্তা রেহনুমা তারাননুম বলেন, ‘শুধু সিলেট নয়, সারাদেশে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে। আমরা সাধ্যমতো সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছি। সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২২০ টন লিকুইড প্রয়োজন হয়। আমরা ১৬০ থেকে ১৭০ টন লিকুইড অক্সিজেন সরবরাহ দিতে পারি।’
সিলেটে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি আর চাহিদামতো অক্সিজেন না পাওয়ায় সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবরাহ পাওয়া গেলে তারা করোনা চিকিৎসার পরিধি আরও বাড়াতে পারতেন।
রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. নাসের হামিদ জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুইশ করোনা পজিটিভ ও করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগী ভর্তি থাকেন। মাঝেমধ্যে অক্সিজেন সংকট হলেও তুলনামূলকভাবে ভালো রোগীদের কাছ থেকে চেয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ক্রিটিক্যাল রোগীদের সাপোর্ট দেওয়া হয়। এই কঠিন সময়ে করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো সাপোর্ট দিতে পারছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রোগী বাড়ায় চাহিদা বেড়েছে। অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে পারলে আমরা চিকিৎসার পরিধিও বাড়াতে পারতাম।’
সিলেটে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. নাসিম হোসাইন বলেন, ‘আমরা সাহস নিয়েই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত করোনার রোগী হাসপাতালে ভর্তি করছি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে অক্সিজেনের সংকট দেখা দিচ্ছে। চাহিদার অর্ধেক অক্সিজেন সরবরাহ করার কারণে অনেক হাসপাতালে নতুন করে রোগী ভর্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। যেসব রোগী ভর্তি রয়েছেন তাদেরকেও চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।’
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানান, সিলেটে করোনার রোগী বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন খরচ হচ্ছে বেশি। ফলে প্ল্যান্টগুলো চাপ নিতে পারছে না। হয়তো বড় ধরনের অক্সিজেন সংকটে পড়তে যাচ্ছে সিলেট।
তিনি বলেন, ‘ওসমানীতে ৩০ হাজার লিটার ও শামসুদ্দিনে ১০ হাজার লিটারের নিজস্ব অক্সিজেন প্ল্যান্ট থাকলেও নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের অন্যান্য জায়গায়ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত দুটি কোম্পানি নিজস্ব পরিবহনের স্বল্পতা দেখিয়ে নিয়মিত অক্সিজেন সরবরাহ করছে না।’ এ সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্টদের একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আরসি-০৬