সিলেটে হচ্ছে দেশের অন্যতম আধুনিক বাস টার্মিনাল

মামুন পারভেজ


মার্চ ১৪, ২০২২
০৫:৫৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মার্চ ১৪, ২০২২
০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন



সিলেটে হচ্ছে দেশের অন্যতম আধুনিক বাস টার্মিনাল

দক্ষিণ সুরমার কদমতলীতে প্রায় ৭ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক বাস টার্মিনাল। ছবি : শেখ নাসির

সিলেটে নান্দনিক নকশা ও উন্নত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন আধুনিক বাস টার্মিনাল নির্মিত হচ্ছে। ১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ সুরমার কদমতলীতে প্রায় ৭ একর জায়গাজুড়ে টার্মিনালটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

টার্মিনালে থাকবে বহির্গমন ও আগমনের দুইটি পৃথক ভবন, একটি প্রশাসনিক ভবন ও বিকল গাড়ি মেরামতের জন্য একটি ওয়ার্কশপ শেড। যাত্রীদের জন্য থাকবে বিশ্রাম কক্ষ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, নামাজের কক্ষ, প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য পৃথক কক্ষ। প্রত্যেক রুটের জন্য থাকবে আলাদা পার্কিং জোন, প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তা। ২০১৯ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় জনভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, কদমতলী বাস টার্মিনালে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং সিলেট থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতকারী যাত্রীদের আধুনিক সেবা নিশ্চিত করতে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বাস টার্মিনাল আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় দুটি কাজ করা হচ্ছে। এর একটি হচ্ছে ডাম্পিং গ্রাউন্ড নির্মাণ, অপরটি টার্মিনালের অবকাঠামো উন্নয়ন। ডাম্পিং আধুনিক বাস টার্মিনাল

গ্রাউন্ডের জন্য ৫২ কোটি টাকা এবং টার্মিনালের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস টার্মিনাল আধুনিকায়নের কার্যাদেশ হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। টার্মিনালটির কাজ শেষ হলে একই সময়ে ৮০ থেকে ৯০টি বাস আসা যাওয়া করতে পারবে। ইংরেজি বর্ণমালার ‘এইচ’ বর্ণের আদলে তৈরি টার্মিনালে দুই তলাবিশিষ্ট দুটি মূল ভবন থাকবে। বহির্গমন ও আগমনের জন্য দুইতলাবিশিষ্ট ভবনে থাকছে অত্যাধুনিক সুযোগসুবিধা। সুপরিসর অভ্যর্থনা, ৪৮টি টয়লেট, ব্রেস্টফিডিং কক্ষ, নামাজের কক্ষ। প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশা, মটর সাইকেল রাখার জন্য টার্মিনালের সামনে প্রশস্ত পার্কিং থাকছে। একই সময়ে ১৪০টি গাড়ি পার্কিং করা যাবে।

যাত্রীদের বিশ্রামাগার, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কক্ষ, প্রথামিক চিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম। সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও ওয়াইফাই জোন থাকবে। প্রত্যেক রুটের জন্য নির্ধারিত টার্মিনাল ও রাস্তা ও ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত তথ্য কেন্দ্র থাকবে; যেখানে সিলেট সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাবেন আগত দর্শনার্থীরা। নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ পাবেন বাস চালকেরা। তবে যেসব পরিবহনের নিজস্ব টার্মিনাল আছে তাদের এই টার্মিনাল ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকছে না। দুই ভবনে যাতায়াতের জন্য কাঁচের গ্লাসের আবরণে ঢাকা একটি ব্রিজ বাড়তি সৌন্দয্যবর্ধন করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ জানায়, ৫৮০০ বর্গমিটার জায়গার উপর নির্মিত বহির্গমন ভবনের নিচতলায় থাকছে ৩০টি টিকেট কাউন্টার, ৫টি ইনফরমেশন বুথ, ২য় তলায় ৯৭০টি আসন সম্বলিত ওয়েটিং স্পেস। এছাড়া ভিআইপিদের জন্য ৩০টি আসন রয়েছে এ ভবনে। ১৫০ সিটের রেস্টুরেন্ট ও ৯০ সিটের ফুডকোর্ট থাকছে বহির্গমন ভবনে। নারী পুরুষদের জন্য আলাদা ৬টি টয়লেট জোনে ৪৮টি টয়লেট থাকবে। ১৪ আসন বিশিষ্ট দুটি ব্রেস্টফিডিং কর্নার, অসুস্থ রোগীদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কর্নার, যাত্রীদের মালামাল রাখার জন্য সুরক্ষিত ১৩টি ‘লকার’ জোন থাকছে এই ভবনে।

দুই হাজার বর্গ মিটারে আগমন ভবনে থাকছে আগত যাত্রীদের জন্য থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা। যাত্রীদের বসার জন্য ৫১০ সিটের ওয়েটিং স্পেস। এই ভবনের ভিআইপিদের জন্য ৩০টি আসন রাখা হয়েছে। দুটি টয়লেট পৃথক জোন। ছয় তলাবিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবনের তিন তলা পর্যন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এতে সিসিটিভি মনিটরিং রুম, ট্যুরিজম করপোরেশন অফিস, ট্যুরিজম পুলিশ সেন্টার, মেডিকেল টিম এবং প্রশাসনিক দপ্তর।

এছাড়া, ৭৫০ বর্গমিটার জায়াগার উপর নির্মিত ওয়েলফেয়ার ভবনে থাকছে বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন সমিতির জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা। ২৫০ আসনের মাল্টিপারপাস সভাকক্ষ, চালকদের বিশ্রামের জন্য ২৪ বেডের বিশ্রামাগার। ওয়ার্কশপ স্পেস, বিদ্যুৎ সাবস্টেশন, অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যস্থা রয়েছে ভবনটির নিচ তলায়। টার্মিনালটি ইজারাভিত্তিক পরিচালিত হলেও রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে সিলেট সিটি করপোরেশন।

টার্মিনালটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে ঢালি কন্সট্রাকশন ফার্ম। কিন্তু দেড় বছরের মধ্যে টার্মিনালটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখনও কাজ শেষ না হওয়ায় কদমতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একধরনের বিশৃংখলা বিরাজ করছে। বিশাল সড়কের পুরোটাজুড়েই রাখা হচ্ছে শতশত গাড়ি। গাড়ির কারণে সড়ক দিয়ে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এ সড়কে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস টার্মিনাল নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে সড়কে গাড়ি রাখতে হচ্ছে। যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় অনেক লোকসান গুণতে হচ্ছে। যথাসময়ে বাস ছাড়তে ও প্রবেশ করতে পারছে না। এতে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে, যাত্রীরাও ভোগান্তিতে পড়ছেন।

সরেজমিনে কদমতলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, টার্মিনালের নির্মাণকাজ চলায় ভেতরে গাড়ি রাখার সুযোগ নেই। চারদিকে শেড দিয়ে নির্মাণ কাজ চলছে। সব গাড়ি টার্মিনালের বাইরে সড়কেই পার্কিং করা। কিনব্রিজ পার হয়ে দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বর পর্যন্ত পুরো সড়ক যেন বাস টার্মিনাল। কেবল সড়ক নয়, আশপাশের বিপণিবিতানগুলোর সামনে, রেলস্টেশনের প্রবেশপথ ও সামনের অংশজুড়েও পার্কিং করে রাখা হয়েছে শতশত বাস।

স্থানীয়রা বলছেন, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। ফলে প্রতিদিন স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শতশত মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই টার্মিনাল থেকে ঢাকা-সিলেট, সিলেট-কুমিল্লা, সিলেট-চট্টগ্রাম, সিলেট-হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন রুটে যানবাহন চলাচল করে। সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার আন্তঃরুটে কোচ, মিনিবাসও এখান থেকে চলাচল করে।

এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও টার্মিনাল নিয়ে আশাবাদী বাসমালিক ও শ্রমিক সমিতি। টার্মিনাল হলে যানজট সমস্যা কমে আসবে বলে তারা মনে করছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সিলেটের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির পলাশ বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন টার্মিনালের কাজ বন্ধ ছিল। এ কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। টার্মিনালের আধুনিকায়ন চলায় সড়কেই গাড়ি রাখতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘যথাসময়ে কাজ না হওয়ায় আমাদের অনেক লোকসান গুনতে হচ্ছে। দীর্ঘ যানজটের কারণে যথাসময়ে বাস ছেড়ে যেতে ও প্রবেশ করতে পারে না। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়।’

সিলেট জেলা বাস মিনিবাস কোচ মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘টার্মিনাল নিয়ে এখনও আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। শুনেছি এটা অত্যাধুনিক ডিজাইনে তৈরি করা হচ্ছে। এতে মালিক ও শ্রমিকদের বিশেষ সুযোগসুবিধা থাকবে বলে আশা করছি। টার্মিনালটি পূর্ণাঙ্গ হলে যানজট সমস্যা কমে আসবে।’

করোনা পরিস্থিতির কারণেই সময়মতো কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন ছন সিসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও টার্মিনাল নির্মাণ কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আলী আকবর। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে বাস টার্মিনালের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু সবচেয়ে বড় এই বাস টার্মিনালটি বিমান বন্দরের আদলে তৈরি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের বাস টার্মিনালের সব সুযোগ-সুবিধা থাকছে এই টার্মিনালে। পর্যটন নগর সিলেটে আগত দর্শনার্থীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হবে।’

আরসি-০৩