এবার বন্যার্তদের পাশে ‘কলের গাড়ি’

বেলাল আহমেদ


জুলাই ০২, ২০২২
০১:২২ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুলাই ০২, ২০২২
০১:২৫ পূর্বাহ্ন



এবার বন্যার্তদের পাশে ‘কলের গাড়ি’

যে সময় মানুষ ছিল ঘরবন্দি। বন্ধ ছিল আয় রোজগারের পথ। সেই করোনা মহামারিকাল থেকে যাত্রা শুরু ‘কলের গাড়ি’র। কল করা মাত্রই সে সময় খাবার নিয়ে ছুটে যাওয়ার কারণে পুরো কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘কলের গাড়ি’। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সিলেট বিভাগের মানুষ এবার পড়েছেন আরও বেশি বিপাকে। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে একেকটি পরিবার। সে পরিবারগুলোর জন্য খাবার নিয়ে অবিরত ছুটে চলছে সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীদের খাদ্য সহায়তার ‘কলের গাড়ি’। 

যে মঞ্চের আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে নাট্যকর্মীরা সংলাপ ছুড়তেন। নৃত্যশিল্পীরা নাচের মুদ্রায় মোহিত করতেন দর্শক হৃদয় কিংবা গানের গভীর সুরে যে সংগীত শিল্পীরা বোধ করে রাখতেন শ্রোতাদের অন্তর, সেই মঞ্চ এখন দিনরাত জেগে আছে মানুষের জন্য। সেই মঞ্চে, সেই শিল্পীরা তৈরি করছেন শ্রমে-ঘামে আর ভালোবাসায় মুড়ানো একেকটি খাবারের প্যাকেট। যে প্যাকেটগুলো ‘কলের গাড়ি’ নিয়ে ছুটছে মানবতার ডাকে, বন্যার্ত মানুষের জন্য। টানা ১৩ দিন ধরে যৌথভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সিলেটের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ। সিলেটের কবি কাজী নজরুল ইসলাম অডিটরিয়াম থেকে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। 


মঞ্চের এককোণে হাতে খাবার প্যাকেট করছেন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মহাশ্বেতা দেব পুরকায়স্থ শশী। দর্পণ থিয়েটারের কর্মী শশীর বয়স দশ বছর। ঠিক তার পাশে বসে প্যাকেটে ডাল ভরছেন ৮১ বছর বয়সী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সুনির্মল কুমার দেব মীন। এভাবে বিভিন্ন বয়সের প্রায় শতাধিক নাট্যকর্মীর কেউ খাবার সামগ্রী প্যাকেট করছেন, কেউ কেউ ছুটছেন বিপন্ন মানুষের জন্য এসব খাবারের প্যাকেট নিয়ে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এ কর্মযজ্ঞ।

এ কর্মজজ্ঞে শামিল হতে পেরে উৎফুল্ল মহাশ্বেতা দেব পুরকায়স্থ শশী বলেন, ‘বন্যার্ত মানুষের জন্য কাজ করতে পেরে ভালো লাগছে। আমরা সবাই মিলে কাজ করলে যে কোনে পরিস্থিতিকে জয় করা সম্ভব।’

সুনির্মল কুমার দেব মীন বলেন, ‘মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য কাজ করার জন্যই মানুষের জন্ম হয়েছে। সবার আদর, প্রেম আর ভালোবাসাই আমাকে এ কাজে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই।’ 


সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্যা শুরুর পর থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচ সহস্রাধিক পরিবারকে তিন লক্ষাধিক টাকার খাদ্য সহায়তা  দেওয়া হয়েছে। সিলেট নগর, শহরতলী থেকে শুরু করে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় পৌঁছে দেওয়া হয় ‘কলের গাড়ির’ এসব খাবার সামগ্রী। কখনও নিজস্ব মোটরসাইকেল কিংবা কখনও ভাড়া করা নৌকায়, পিকআপ ভ্যানে বা সিএনজিচালিত অটো রিকশায় কলের গাড়ির খাবার পৌঁছে যায় দুর্গত মানুষের দুয়ারে। এখন পর্যন্ত সিলেটের সিলেট সদর, সিলেট নগর, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তা, সুনামগঞ্জের সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ, দিরাই উপজেলার প্রায় অর্ধশত এলাকায় ‘কলের গাড়ি’র খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধী, লাইট, ডেকোরেটার্সসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বন্যায় দুর্গত কর্মীদের মধ্যেও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়।  

সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত জানান, করোনাকালে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার বন্যার শুরু থেকেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার, বাচ্চাদের জন্য তরল দুধ দেওয়া শুরু করা হয়। একই সঙ্গে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে নিজেদের বাসায় বিপন্ন অবস্থায় রয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাসায় বাসায় গিয়েও এসব খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৮ মার্চ থেকে প্রথম এভাবে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ শুরু করে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ। ‘কলের গাড়ি’ নাম দিয়ে এ কার্যক্রম পরিচালনা করে সংগঠনটি। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে এ কার্যক্রমে যুক্ত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। যখন একটি নাম্বার দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তখন থেকেই মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেন তাদের পরিচয় গোপন রেখেই সেবা দিয়ে যাচ্ছে ‘কলের গাড়ি’। আর তাই নির্দ্বিধায় সাধারণ মানুষ ফোন করে সেবা নিতে থাকেন। 

খাদ্যসামগ্রী নিতে সিলেট নগরের উপশহর এলাকা থেকে এসছেন শামীমা বেগম (ছদ্মনাম) (২৮)। বুধবার রাতে ফোন করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন এ গৃহিনী। তিন সদস্যের ঘরে খাবার সংকট দেখা দেওয়ায় তিনি এ সহায়তা নিতে এসেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘অনেককে দিলেও আমরা মধ্যবিত্তরা হাত পাততে পারি না। পরে ‘কলের গাড়ি’র সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার এ খাদ্যসামগ্রী দেন। ভালো লাগছে।’ 

একই কথা বললেন নগরের তেররতন এলাকার আলিমা বেগমও (ছদ্মনাম)। তিনিও কারও মাধ্যমে খবর পেয়ে এসেছেন খাবারের প্যাকেট নিতে। তিনি জানান, গত বুধবার রাতে ফোন করে নিজের সবকিছু জানানোর পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে খাবার সামগ্রী সংগ্রহ করতে বলা হয়। খাবার পেয়ে ‘কলের গাড়ি’র প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।   

রজতকান্তি গুপ্ত দৈনিক সিলেট মিররকে বলছিলেন, ‘যে মঞ্চে আমরা গান, আবৃত্তি, নৃত্য, নাটক শিল্পচর্চা তুলে ধরি সেই মঞ্চে বন্যার্তদের জন্য খাবার প্যাকেট প্রস্তুত করছি এবং সে খাবারের প্যাকেট তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছি। মহামারির সময় মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। কিন্তু এবার মানুষ ঘরতে থেকে বের হতে পারলেও খাবার পাচ্ছে না। সিলেট ও সুনামগঞ্জবাসী এমন দুর্যোগ এর আগে দেখেনি। তাই আমাদের শতাধিক সংস্কৃতিকর্মী নিরলসভাবে তাদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন।’


বন্যার্তদের জন্য এ খাদ্য উপহারের কার্যক্রমের শুরুতে প্রথম অর্থায়ন করে সিলেট সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ ও গ্রাম থিয়েটার। মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে এ যাত্রা শুরু করে ‘কলের গাড়ি’র বন্যার্তদের খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম। প্রথম ধাপে চিড়া, মুড়ি, খাবার সেলাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, বিশুদ্ধ খাবার পানি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে খাদ্যসামগ্রীর প্রতিটি প্যাকেটে রয়েছে চাল, আলু, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও মসুর ডাল। এ ছাড়াও শিশুদের জন্য দুধ, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটের পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে স্যানেটারি ন্যাপকিনসহ কেউ জরুরী ওষুধ চাইলেও তা দেওয়া হচ্ছে।  

রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, ‘আমাদের তিন সংগঠনের ৩০ হাজার টাকা দিয়ে প্রথম এ কার্যক্রমের সুচনা করি। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও পরেরদিন সাহস বাড়িয়ে দেন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল। তিনি কাজ করার বড় একটি ক্ষেত্র তৈরি করে দেন। এর পর গ্রাম থিয়েটার, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঢাকা, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ঢাকা, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মীদের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, আবৃত্তি সংগঠন, নৃত্য সংগঠনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রবাসী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তাঁদের তহবিলে আর্থিক সহায়তা করছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন করোনাকালের মতই কোনো ধরনের ভাড়া ছাড়া এ কাজের জন্য কবি নজরুল অডিটোরিয়ামটি তাঁদের ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। শুধু তা-ই নয় সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব চাল সরবরাহ করছেন। পাশাপাশি নগদ টাকা ও শিশুদের জন্য দুধসহ সর্বাত্বক সহযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানানো হয়।  আগ্রহী যে কেউ ০১৭১১৪৬৯৭১৫ ও ০১৭৩৫০২৪২০৫ (ব্যক্তিগত) নম্বরে বিকাশ করে এ আয়োজনে সম্পৃক্ত হতে পারেন। প্রয়োজন হলে ০১৯৮৮২২২৪২২ এ নম্বরে যোগাযোগ করে যে কেউ সহযোগিতা নিতে পারবেন বলেও জানান তারা। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, শতাধিক সংস্কৃতিকর্মী প্রতিদিন খাদ্যসামগ্রী কেনা ও প্যাকেটজাত করা থেকে শুরু করে পৌঁছে দেওয়া ও অনুদান গ্রহণ-খরচের তথ্য সংগ্রহে আলদা আলাদাভাবে কাজ করছেন। পুরো কাজ সমন্বয় করছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ। 

নাট্য সংগঠক নীলাঞ্জন দাস টুকু দৈনিক সিলেট মিররকে বলেন, ‘এমন কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে ভালো লাগছে। আমি ছোট বেলা থেকেই রক্তদান করে আসছি। সেই থেকেই মানুষের জন্য কিছু করার একটা স্পৃহা সবসময় আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।  গান-নৃত্য-আবৃত্তি-নাটক মূলত মানুষের উৎকর্ষ সাধনেরই অনুষঙ্গ। মানবতার কল্যাণেই ‘কলের গাড়ি’র সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন নাট্যকর্মীরা। আমিও যতদিন মানুষের জন্য সামান্যতম কিছু করার সুযোগ পাব ততদিনই মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই।’

সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ চৌধুরী মিশু দৈনিক সিলেট মিররকে বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা করোনাকালে এ কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। সেই কাজের অনুপ্রেরণা থেকেই এবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আগেরবার প্রস্তুতি নিতে দেরি হলেও এবার আর দেরি হয়নি। আগের কাজের সাফল্যের কারণেই এবার সবার সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা অব্যাহত রয়েছে।’

এরই মধ্যে পাঁচ হাজারেরও বেশি পরিবারে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এ সংখ্যা ২০ হাজারে পৌঁছাবে।’

খাদ্য সহায়তা দিয়েই থেমে থাকতে চায় না কলের গাড়ি। মিশফাক আহমদ চৌধুরী মিশু বলেন, ‘খাদ্যসামগ্রীতো সবাই দিচ্ছি। হয়ত একবেলা খাওয়া যাবে। অন্য বেলা না খেয়ে থাকব। কিন্তু এবারের বন্যা মানুষের ঘর-বাড়ি, ধান-চালসহ সব নিয়ে গেছে। মানুষকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে। তাই বন্যা পরবর্তী সময়ে মানুষের ঘর নির্মাণ, বীজ প্রদানসহ আরও একটা ফসল মানুষের ঘরে না উঠা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে আমাদের থাকা উচিত। কলের গাড়িও সে পরিকল্পণা করে এগিয়ে যাচ্ছে। সবার সহযোগিতা থাকলে আমরা সেভাবেই কাজ করে যেতে চাই।’     

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চক্রবর্তী দৈনিক সিলেট মিররকে বলেন, ‘মানুষের জন্য করাটা অনেক তৃপ্তির। সে কাজটিই করে যাচ্ছেন সিলেটের সংস্কৃতিকর্মীরা। আমাদের তরুণ নাট্যকর্মীরা ঘুম-খাওয়া ভুলে অনবরত কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের নিয়ে গর্ব হয়। আমি নিজেও বন্যা কবলিত ছিলাম। এ ক্রান্তিকালে মানুষের পাশে দাঁড়ানো কতটা প্রয়োজন সেটা আমি জানি। মানুষ যখন এ সহায়তা পেয়ে আপ্লুত হয়, তখন তৃপ্তি পাই। মানবিক যে কোনো সংকটে সাংস্কৃতিক জোট ও সম্মিলিত নাট্য পরিষদ কাজ করে যাবে।’   

মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সংস্কৃতিকর্মীদের সর্বোচ্চ দায়িত্ব বলে মনে করেন ‘কলের গাড়ি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। সব সংকটে নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা সর্বোচ্চ শক্তি, মেধা ও শ্রম দিয়ে মানুষের পাশে থাকতে চান।

বিএ-০১