১২শ কোটি টাকার হিসাব দিলেন মেয়র আরিফ

নিজস্ব প্রতিবেদক


জুলাই ১৯, ২০২২
১০:২৫ অপরাহ্ন


আপডেট : জুলাই ২০, ২০২২
১০:১৯ অপরাহ্ন



১২শ কোটি টাকার হিসাব দিলেন মেয়র আরিফ
’জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নগরের জলাবদ্ধতা’

সম্প্রতি সিলেট নগরে ভারী বৃষ্টিতে নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নগর ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে এর কারণ ও পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজের পদক্ষেপের বর্ণনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে সরকারের বরাদ্দ ১২শ কোটি টাকার হিসাব দিয়েছেন তিনি।

মেয়র বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সিলেটের উন্নয়নে ১২শ ২৮ কোটি টাকা শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই পরিমাণ অর্থ পেতে বিধি অনুযায়ী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি করপোরেশনকে নিজস্ব আয় থেকে ২০ শতাংশ অর্থ্যাৎ, ২৪৫ কোটি যুক্ত করতে হবে। ৮০ শতাংশ অর্থ্যাৎ ৯৮২ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার দেবে। বরাদ্দের পুরো টাকা চারটি অর্থ বছরে ছাড় দেওয়া হবে।’

দুই অর্থবছরে ৩২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে জানিয়ে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এই বরাদ্দের প্রথম ধাপে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ১২৯ কোটি টাকা পায় সিসিক। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দুইশ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। এখন পর্যন্ত ৯৮২ কোটি টাকার মধ্যে সিসিক পেয়েছে ৩২৯ কোটি টাকা।’
গণমাধ্যমে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সিসিকের ১২শ কোটি টাকা জলে গেছে কিংবা হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কোন কাজে আসেনিÑ এমন তথ্যকে ‘অপপ্রচার’ বলে মনে করেন সিসিক মেয়র। এ বিষয়ে নাগরিক ও গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহŸান জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে সিসিক মেয়র আরও বলেন, ‘সরকারি অর্থ কারো পক্ষে স্বেচ্ছাচারি হয়ে খরচ করা অসম্ভব। নজরদারির জন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নের নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে।’

মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে নগরের ড্রেন, ছড়া উন্নয়ন হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সিসিকের মাস্টার প্লান প্রণয়নের সময় সরকারের যথাযথ নিয়ম মেনে সিলেটের প্রকৃতি বিবেচনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করা হয়। ইন্সিটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং- আইডব্লিউএম  ফিজিবিলিটি স্ট্যাডির কাজ করে। সেই অনুযায়ী সিসিকের ছড়া, ড্রেনের উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হচ্ছে। ড্রেনের প্রসার বা বর্ধিতকরণ কতো হতে পারে সেটা, জলাবদ্ধতা নিরসনে মহানগর এলাকার নিম্নাঞ্চল এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় স্লুইস গেট নির্মাণ এবং পাম্প হাউস স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সিসিক পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করছে।’

তিনি বলেন, মাস্টার প্লানে নগরের রাস্তাগুলোকে ৮০ ফুট চওড়া করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা নাগরিকদের বাসাবাড়ির অসুবিধা বিবেচনায় ৮০ ফুট রাস্তা করতে পারিনি। কারণ, বেশির ভাগ এলাকায়ই ৮০ ফুট রাস্তা করার বাস্তবতা এখন আর নেই। এ কারণে রাস্তা বর্ধিত করতে হয়েছে পারিপার্শিকতা বিবেচনায়। সে অনুযায়ী ড্রেনও নির্মাণ করা হয়েছে।’

‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’ বলায় অনেকটা ক্ষোভও প্রকাশ করেন মেয়র। তিনি বলেন, ‘নানা মাধ্যমে, কোন কোন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক বা অতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিসিকের ‘অপরিকল্পিত উন্নয়ন’-এর ফলে হচ্ছে বলছেন। সিসিক সরকারের অন্যসকল দপ্তর, সংস্থার মতোই উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়নে সরকারের সব বিধি নিয়ম মেনেই করছে। একটি প্রকল্প প্রণয়নের সময় থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ, সংশ্লিষ্টদের মতামত, গবেষণা-পর্যালোচনা করেই কাজটি করা হয়। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়। কেউ যদি সরকারের নিয়ম নীতি মেনে যথা উপায়ে করা উন্নয়ন কাজকে ‘অপরিকল্পিত’ বলে আখ্যায়িত করেন, সেটা কতোটা যুক্তিসংগত হবে?’

দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে সিসিক টানা ৩ বার সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজেকর্মে ভুল থাকলে নিশ্চয় সরকারিভাবে আমরা শ্রেষ্ঠ হতাম না।’ সংবাদ সম্মেলনে সিসিক মেয়র যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবাইকে এক সঙ্গে কাজ করার আহবান জানান।
এ সময় তিনি উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক ও অতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সিসিকের করণীয় তুলে ধরেন।

সিসিক মেয়র লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জ বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে এই সমস্যা প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সিলেটে অতিবৃষ্টি, তীব্র তাপদাহ, শীতকালে গরম অনুভূত হওয়া কিংবা তীব্র কুয়াশা তথা আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিশেষজ্ঞদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।’

তিনি বলেন, ‘ভয়াল বন্যার পর একটানা তাপদাহ নতুন করে সংকটে ফেলেছে। এরমধ্যে গত শনিবার দিনে অস্বাভাবিক তাপদাহের পর রাতে অল্প সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির কারণে আকস্মিক জল-দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে নগরবাসীকে।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতার কারণে ওই রাতে দুর্ভোগের শিকার হয়েছি আমি নিজেও। রাত ১১টা ২ মিনিট থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত প্রায় ৫৮ মিনিটে ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত মোট ৬ ঘণ্টা ৫৮ মিনিটে ১৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। যা সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। এটিকে ‘অতি প্রাকৃতিক’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।’

দুর্যোগ মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ও নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মতবিনিময়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন বলে জানান মেয়র। তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী  জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চলতি বছরে এমন ঘটনা আরও ঘটতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় আমরা সিসিকের জরুরি সভা আয়োজন করেছি। দুর্যোগ হলে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করেছি।’

এ সময় তিনি জানান, দিন কিংবা রাতে অতি বৃষ্টি শুরু হলে সিসিকের ৮টি স্ট্রাইকিং টিম পরিচ্ছন্নতার কাজে প্রস্তুত রয়েছে। মেয়র, কাউন্সিলর, কর্মকর্তা কর্মচারীরা মাঠে থাকবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অতি বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় সিসিকের কিছু ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বন্যার পর নগরের ছড়া-খাল, ড্রেনের ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করছিলাম। এরই মধ্যে কোরবানির ঈদ চলে আসে। ঈদের সময় পশুর হাট ও কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের দিকে আমরা গুরুত্ব দিয়েছিলাম। যার সফলতা আপনারা দেখেছেন। কিন্তু, ঈদের পরপরই শুরু হয় তীব্র তাপদাহ। জনজীবন নতুন করে বিপর্যস্ত হয়। ফলে ড্রেনের অবর্জনা শতভাগ পরিচ্ছন্ন আমরা করতে পারিনি।’

মেয়র বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় অনেকে ছড়া-ড্রেনে বিভিন্ন ধরনের অপচনশীল বর্জ্য যেমন, বালিশ, তোষক, ককশিট, প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি নির্বিচারে ফেলে রেখেছেন। যার ফলে অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ বৃষ্টি হওয়ায় সাময়িক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিসিক তাৎক্ষণিক পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে সিসিক মেয়র আরও বলেন, ‘জলবদ্ধতা নিরসনে সম্মানিত নাগরিকদের যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। সময় আবর্জনা ফেলতে হবে নির্দিষ্ট স্থানে।’ এ জন্য তিনি নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ ও পূর্বাভাস নিয়ে বক্তব্য দেন, সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী।

এ সময় সিসিকের বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায়, প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা, গণমাধ্যম কর্মরত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

এসএইচ/০৫