কয়েকটা গাড়ি পোড়ালেই সরকার পড়ে যাবে, অত সহজ না: প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক


ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
০৮:২২ অপরাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
০৯:৫৩ অপরাহ্ন



কয়েকটা গাড়ি পোড়ালেই সরকার পড়ে যাবে, অত সহজ না: প্রধানমন্ত্রী


সিলেটবাসীর কাছে নৌকায় ভোট চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এই নৌকা নূহ নবীর নৌকা। এ নৌকায়ই মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। এই নৌকায় ভোট দিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে। আবার নৌকা যখনই ক্ষমতায় এসেছে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হয়েছে।

এ সময় তিনি আগুন সন্ত্রাস প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি শুধু এইটুকু বলতে চাই, দু-চারটা গাড়ি পুড়িয়ে সরকার ফেলে দেওয়া যাবে না। নির্বাচন ঠেকানো যাবে না। বরং আগুন নিয়ে খেলতে গেলে আগুনেই হাত পুড়ে যাবে।’

আজ বুধবার বিকেলে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী আলিয়া মাদরাসা মাঠে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দা জেবুন্নেছা হক, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ইনাম আহমদ চৌধুরী প্রমুখ।



জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার হারানোর কিছু নেই, আমি সব হারিয়েছি। কেবল এক বোন ছাড়া আমার আর কেউ নেই। এই জনগণই আমার সব।তাই আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।’

শেখ হাসিনা চলমান আগুন সন্ত্রাসের সমালোচনা করে বলেন, ‘বিএনপি আজ কী করছে? আমরা যখন উন্নয়নের কাজ করছি তখন তাদের কাজ হচ্ছে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো। কোনো মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ থাকলে এইভাবে আগুন দিয়ে মা-শিশু, মা-সন্তানকে বাঁচানোর জন্য কোলের মধ্যে ধরে রেখেছে, সেই মা আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে বাচ্চাসহ। আজকে সেই আগুন দিয়ে রেল পোড়াচ্ছে, বাস পোড়াচ্ছে, গাড়ি পোড়াচ্ছে।’

২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১৩ সাল। তাদের অগ্নিসন্ত্রাস। তখন ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ছিল। সে নির্বাচন ঠেকানোর নামে এই বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করে। ৫৮২টি স্কুলঘর পুড়িয়ে দেয়, ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়। ৭০টি সরকারি অফিস ভাঙে। ছয়টি ভূমি অফিস ভাঙে। তিন হাজার ২৫২টি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। যেখানে যাত্রীবাহী গাড়ি ছিল, মানুষ এর ভেতরে পুড়ে কয়লা হয়। যাকে আগুন দেয়, হেলপার সেখানে কয়লা হয়ে থাকে। ২৯টি রেলগাড়ি, দুটি লঞ্চ পুড়িয়েছে, সেই ২০১৩ থেকে ’১৫ পর্যন্ত তাদের এই অগ্নিসন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, তিন হাজারের মতো মানুষ পুড়ে যায়। ৫০০-এর মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এখনো সে মানুষগুলো পোড়া ঘা নিয়ে কষ্ট করে জীবন যাপন করছে।’


সিলেটের উন্নয়নে তাঁর সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারে ১৫ বছরের যেসব উন্নয়ন হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এই সিলেটে আমরা যেভাবে উন্নয়ন করেছি, সিলেটবাসি আমি জানি না সেটা মাথায় রাখবেন কি না। আমাদের যে লক্ষ্য ছিল, আমরা দেখেছি সিলেটের মানুষ সবসময় জনগণের পাশে আছে। সেই আগরতলা মামলা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা আমাদের সঙ্গে আছেন। কাজেই গত ১৫ বছরে এই সিলেটে আমরা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এসেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান বীর নিবাসের নির্মাণ কাজ চলছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে ২ শতাংশ জমিসহ ৫ হাজার ৫৪৩টি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছি। ৫টি মডেল মসজিদ ও ইসলামি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আরও ৯টির নির্মাণ কাজ চলছে।’

তিনি বলেন, ‘সিলেটের প্রত্যেকটায় জেলা ও উপজেলায় আমরা করে দিচ্ছি। ফায়ার সার্ভিসের অফিস সব উপজেলায় ছিল না। আমি সরকারে এসে সিদ্ধান্ত নেই, প্রতি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন হবে। সিলেটে ১০টি আধুনিক ডিফেন্স স্টেশন নির্মাণ হয়েছে। ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-সিলেট রাস্তার ৬ লেনে উন্নীত করে দিচ্ছি। ৪ লেন দ্রুত যান ও দুই পাশের স্বল্প গতির গাড়ির জন্য আলাদা লেন নির্মাণ করছি। সিলেটের বিমানবন্দর এই আওয়ামী লীগ সরকারই করে দিয়েছে। সিলেট-বাদাঘাট বিমানবন্দর সড়ক ৪ লেনে উন্নীত হচ্ছে। সিলেট-সুনামগঞ্জ ও সিলেট-তামাবিল সড়ক চার লেনে উন্নীত হচ্ছে। জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে সাদপাথর পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়কের কাজ চলমান। এসব খুব দ্রুতই শেষ হবে।’ তিনি বলেন, ‘তামাবিল স্থল বন্দর, শেওলা স্থল বন্দর এর কাজও আমরা উদ্বোধন করে দিয়েছি। হাওর অঞ্চলে ফিশ ল্যান্ডিং আমরা নির্মাণ করে দিয়েছি। যেন মাছ সংরক্ষণ করে রপ্তানি করা সম্ভব হয়। সেই সঙ্গে হাইটেক পার্ক আমরা সারাদেশে নির্মাণ করেছি, সিলেটেও একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়া ইনফরমেশন সেন্টার আমরা নির্মাণ করে দিয়েছি ৬টি স্কুলে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ আপনারা জানেন একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আমরা গড়ে তুলেছি। আমাদের কাজই হচ্ছে জনগণের সেবা করা। আজকে আমি শুধু এটুকু বলব, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব কথা দিয়েছিলাম। বাস্তবায়ন করেছি। এখন করব স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ হচ্ছে সাস্টেনেবল ইকোনমি। অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব, উন্নত, স্থায়ী, টেকসই উন্নয়ন এবং মেরিট বেইজড অ্যাডুকেশন। মেধা, দক্ষতা, প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি অর্থাৎ স্মার্ট পিপল আমরা গড়ে তুলব। অ্যাডভান্স সোসাইটি অগ্রসর, উন্নত, উদার, অগ্রসমান-আমরা অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ে তুলব, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।

আর রাইটওয়ে বাংলাদেশ-সুষম উন্নতি। সকলের জন্য সমান উন্নতি যাতে হয় সে ব্যবস্থা করব। ট্রান্সপারেন্স বাংলাদেশ-স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, উন্নতা সমৃদ্ধ জবাবদিহিতামূলক সামাজিক মূল্যবোধ। অর্থাৎ স্মাট সোসাইটি-এটাই আমরা গড়ে তুলব। স্মার্ট গভমেন্ট, স্মার্ট পিপল, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি-সেটা করেই বাংলাদেশকে আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন বাংলাদেশ গড়ে তুলব। 

দীর্ঘ বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি নৌকা মার্কার ভোট দিতে হাত তুলে ওয়াদা করতে বলেন উপস্থিতদের। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী নির্বাচন, নৌকা মার্কার। এই নৌকা নূহ নবীর নৌকা। এই নৌকায়ই কিন্তু মানব জাতিকে রক্ষা করেছিলেন আল্লাহ রব্বুল আল আমিন। এই নৌকায় ভোট দিয়ে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা পেয়েছে। আবার এই নৌকা যখন সরকারে এসেছে বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়েছে।’

তিনি মাদ্রাসা মাঠে উপস্থিতদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আজকে তাই আপনাদের কাছে আমার আহবান, আমরা যারা নৌকা মার্কায় প্রার্থী দিয়েছি তাদের ভোট দিয়ে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন-আপনাদের কাছে সেটাই আমার আহবান। আপনারা দেবেন? বলেন? হাত তোলে ওয়াদা করেন।’ 

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।Ñকেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না সেটাই আমি বলে যেতে চাই।’ 

‘রিক্ত আমি, নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই। আছে শুধু ভালোবাসা- সিলেটবাসী আপনাদের জন্য দিয়ে গেলাম তা-ই’- বলে বক্তব্য শেষ করলেও পরে আরো যুক্ত করেন, ‘দেরি হয়ে গেল। যাচ্ছি আবার দেখা হবে। সবাই বিজয়ী হন আবার আসব। আবার আসিব ফিরে-এই সিলেটে। খোদা হাফিজ।’

বেলা ২টায় জনসভা শুরুর কথা থাকলেও দুপুরের আগেই মাদরাসা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। বেলা পৌনে ১টার দিকে সভার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকেল ৩টা ৯ মিনিটে সভাস্থলে আসেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচার শুরু করতে সকাল সাড়ে ১১টায় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তাকে অভ্যর্থনা জানান কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। এরপর প্রটোকলবিহীন গাড়িতে তিনি প্রথমে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করেন। এরপর হযরত শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে সার্কিট হাউসে যান। এ সময় তার ছোট বোন শেখ রেহানা সঙ্গে ছিলেন।

সর্বশেষ গত বছরের ২১ জুন বন্যার্তদের দেখতে সিলেট ও সুনামগঞ্জ সফর করেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি সিলেট সার্কিট হাউসে এক মতবিনিময়সভায়ও অংশ নেন। তবে ২০১৮ সালের পর আজই প্রধানমন্ত্রী সিলেটে কোনো জনসভায় ভাষণ দেবেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ২৯ মে প্রথমবার সিলেট সফরে আসেন শেখ হাসিনা। সে সময়ও তিনি সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে ভাষণ দেন। এরপর ১৯৮৬ সালের ১০ অক্টোবর সিলেট সফরকালে আলিয়া মাদরাসা মাঠে আয়োজিত এক জনসভায় বক্তব্য দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিয়মিত বিরতিতে সিলেটে নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন। প্রতিবার নির্বাচনের আগে সিলেটে এসে মাজার জিয়ারত করে জনসভার মাধ্যমে সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন তিনি।



এসই/০১