এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

সিলেট মিরর ডেস্ক


জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
০২:৩৮ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ২৮, ২০২৪
০২:৩৮ পূর্বাহ্ন



এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা


অভিমান, প্রেমঘটিত কারণ, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও মানসিক সমস্যায় ২০২৩ সালে সারা দেশে ৯৮ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৪২ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৩ থেকে ১৯ বছর। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি নারী।


সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে

সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা : পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়’ শিরোনামে গতকাল শনিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের ১০৫টি জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টাল থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার তথ্য সংকলিত করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত বছর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলের ২২৭ জন, কলেজের ১৪০ জন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮ জন ও মাদরাসার ৪৮ শিক্ষার্থী।

এর মধ্যে পুরুষ শিক্ষার্থী ২০৪ জন এবং নারী শিক্ষার্থী ৩০৯ জন। ২০২২ সালে মোট ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। সেই হিসাবে ২০২৩ সালে আত্মহত্যা কিছুটা কমলেও আশানুরূপ নয় বলে মনে করছে সংস্থাটি।

সংবাদ সম্মেলনে আত্মহত্যার তথ্য তুলে ধরার পাশাপাশি এর কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

বক্তারা আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা আনার ওপর জোর দিয়েছেন। বক্তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে যেন তারা কখনো নিজেদের বিচ্ছিন্ন অনুভব না করে। আবেগ প্রকাশে আস্থার জায়গা না পাওয়ায় কম বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীর আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি বলে মনে করেছেন বক্তারা।

লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনুবিভাগ) মো. সাইদুর রহমান বলেন, এই বয়সে আবেগজনিত সমস্যা, পড়ালেখার চাপ ও পারিবারিক চাপের কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করতে দেখা যায়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের এই সমস্যাগুলো শনাক্ত করা হয় না। তারা সমস্যার কথা বলার মতো জায়গাও পায় না।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনায় বসা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাইদুর রহমান। যেসব প্রতিষ্ঠান আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করে তাদের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, অভিমান ও প্রেমের সম্পর্কের মতো আবেগীয় জটিলতা থেকে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের আবেগীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদানের মধ্যে এবং পাঠ্যক্রমে কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, তা দেখা দরকার। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করা জরুরি। একজন শিক্ষার্থী যেন তাঁর মনের কথা খুলে বলার জায়গা পান। তিনি যেন নিজেকে বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন মনে না করেন। পড়াশোনার বাইরে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাঁদের মধ্যে এই বার্তা ছড়াতে হবে যে জীবন মূল্যবান এবং জীবন একটাই। জীবনে উত্থান-পতন থাকেই।’


মান-অভিমানে আত্মহত্যা বেশি

আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় দেখা গেছে, অভিমান ও প্রেমের সম্পর্কের মতো আবেগের কারণে আত্মহত্যার হার বেশি। অভিমানে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৬৫ জন বা ৩২.২ শতাংশ। এর পরই প্রেমঘটিত কারণে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে ১৪.৮ শতাংশ। মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় ৯.৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, পারিবারিক কলহজনিত কারণে ৬.২ শতাংশ, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ১.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী।

সমীক্ষা বলছে, ২০২৩ সালে পড়াশোনার চাপের সম্মুখীন হয়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ায় ৪.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩.৫ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয়ে বেঁচে থাকার পথ রুদ্ধ করে ১.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ২.৫ শতাংশ এবং অপমানবোধ করে আত্মহত্যা করে ০.৮ শতাংশ।


 আত্মহত্যায় শীর্ষে ঢাকা বিভাগ

২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ১৪৯ জন। এর পরই রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এই বিভাগে আত্মহত্যা করেছে ৮৯ জন। রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬৪ জন, বরিশাল এবং রংপুর উভয় বিভাগেই ৪৩ জন করে, ময়মনসিংহে ৩৬ জন। এ ছাড়া সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় এখানে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।


আত্মহত্যায় নারীর হার বেশি

গত বছর আত্মহত্যা করা ৫১৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০.২ শতাংশই নারী। শুধু নারী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ বিবেচনায় দেখা যায়, অভিমানে ২৮.৮ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী, প্রেমঘটিত কারণে ১৬.৫ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮.৪ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৭.১ শতাংশ, যৌন হয়রানির কারণে ৩.৯ শতাংশ এবং পড়াশোনার চাপজনিত কারণে ৪.২ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় একই সংখ্যক শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

এ ছাড়া পারিবারিক নির্যাতনে ১.৬ শতাংশ, অপমানে ০.৬ শতাংশ এবং পাবলিক পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়ার কারণে ২.৯ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।


শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক পর্যালোচনা

আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ২২৭ জনই, অর্থাৎ ৪৪.২ শতাংশ ছিল স্কুলগামী। এ ছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিল ১৪০ জন, যা ২৭.৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছিলেন ৯৮ জন, যা ১৯.১ শতাংশ এবং আত্মহননকারীদের মধ্যে মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ৪৮ জন, যা ৯.৫ শতাংশ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোর বয়সে হরমোনজনিত কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। যার কারণে তারা আত্মহত্যার মতো অতি আবেগীয় সিদ্ধান্তগুলো নেয়।


কিশোর-কিশোরীদের ঝুঁকি বেশি

আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা, যা সংখ্যায় ৩৪১ জন বা ৬৬.৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২২২ জন নারী শিক্ষার্থী এবং এর বিপরীতে পুরুষ শিক্ষার্থী ১১৯ জন। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২৩.৪ শতাংশ। ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২.৩ শতাংশ। ১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৭.৮ শতাংশ।


বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা

৫১৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯৮ জন, যা মোট সংখ্যার ১৯.১ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬ জন, সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ জন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন, মেডিক্যাল কলেজের ছয়জন, নার্সিং ইনস্টিটিউটের পাঁচজন, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দুজন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন এবং অন্যান্য ১৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

এর মধ্যে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২৩ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ব্যাপকহারে আত্মহত্যার পেছনে যে কারণটি দায়ী সেটি হলো প্রেমঘটিত কারণ, যা ১৬.৫ শতাংশ, মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়েও ২২.৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।


১০টি সুপারিশ

আত্মহত্যা কমাতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে ১০টি সুপারিশ তুলে ধরেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। এগুলো হলো—১. স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। ২. প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে মেন্টর নির্ধারণ এবং উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি। ৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেন্টাল হেলথ কর্নার চালু করা। ৪. শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা। ৫. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রচার চালু করা। ৬. পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতা শেখানো। ৭. যেকোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শিক্ষার্থীদের কৌশল, মানকি চাপ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো। ৮. শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবারের সদস্যদের আত্মহত্যার আলামত সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করা। ৯. মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ইনস্যুরেন্স বীমার আওতায় আনা, যেন তা সবার জন্য সাশ্রয়ী হয় এবং ১০. মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে।


কালের কণ্ঠ/ এএফ-০২