‘এই সন্তানদের কাছে কাজী হুজুর হয়েই থাকতে চাই’

ছাতক প্রতিনিধি


জুন ০২, ২০২৪
০৩:০৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুন ০২, ২০২৪
০৩:০৩ পূর্বাহ্ন



‘এই সন্তানদের কাছে কাজী হুজুর হয়েই থাকতে চাই’
-বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কাজী মশহুদ


‘শিক্ষকরা কখনও অবসর নেন না। আমরা চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেও শিক্ষার্থীদের মাঝে চির জাগরুক থাকতে চাই। প্রয়োজনে আপনারা যখন ডাকবেন আমাকে পাবেন। এই মাদ্রাসার অফিস কক্ষ, চার দেয়াল, চেয়ার, আসবাবপত্র, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ আমার ভীষণ প্রিয়। আমার সন্তানসমতূল্য শিক্ষার্থীদের আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। সবকিছু আমাকে মনে করিয়ে দেবে একদিন আমিও ছিলাম। আমার ৪৫০ সন্তানকে আপনাদের হাতে রেখে যাচ্ছি আপনারা তাদের আগলে রাখবেন। অনাগত দিনেও যারা ভর্তি হবে তারাও আমার সন্তান। আমি আমার এই বাচ্চাদের কাছে কাজী হুজুর হয়েই থাকতে চাই বাকীটা জীবন।’ 

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ধারণ নূতন বাজার দাখিল মাদ্রাসায় একটানা ২৯ বছর ১১ মাস শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরগ্রহণ উপলক্ষে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেন শিক্ষক কাজী মশহুদ আহমদ। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি কাজী হুজুর নামেই সমাদৃত। 

শনিবার (১ জুন) মাদ্রাসার হল রুমে তার বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান মানিক। 

শিক্ষক মশহুদ আহমদ বলেন, ‘এই মাদরাসায় শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হয়েছিলাম তরুণ বয়সে আর আজ বিদায় নিচ্ছি পরিণত বয়সে। মাঝখানের এই দীর্ঘ জার্নিতে হাজারো স্মৃতি মনে পড়ে যায়। এই মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ট সময় কাটিয়েছি। এখান থেকে অবসরের মাধ্যমে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা থেকে বিদায় নিচ্ছি। গত ৩৭ বছর আমার জীবনের রুটিন ছিল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করা, পরেরদিন কী পড়াবো সেই চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম থেকে উঠে কাঁদা পানি, মেঘ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমার সন্তানদের পাঠদান করাতে আসা। মাদরাসায় আমি এত এত সন্তান পেয়েছিলাম যে আমার নিজের সন্তানদের সময় দিতে পারিনি।’

শিক্ষক কাজী মশহুদ আহমদ বলেন, আপনারা জানেন শিক্ষকরা কখনো অবসর নেন না আমরা চাকরি জীবন থেকে অবসর নিলেও শিক্ষার্থীদের মাঝে চির জাগরুক থাকতে চাই। এই মাদরাসার প্রয়োজনে আপনারা যখন ডাকবেন আমাকে পাবেন। আমরা শিক্ষকদের মাঝে বহুমত এবং চিন্তা-চেতনার পার্থক্য রয়েছে। তবুও সব সংকটময় মুহূর্তে আমরা একত্রিত হয়েছি এবং সেই সংকট মোকাবেলা করেছি। আমি আমার এই বাচ্চাদের কাছে কাজী হুজুর হয়েই থাকতে চাই বাকীটা জীবন। 

প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য মহিবুর রহমান মানিক বলেন, আজকে যার বিদায় সংবর্ধনায় এসেছি তিনি এ মাদরাসার একজন অত্যন্ত স্বনামধন্য শিক্ষক। তিনি আমার ভাই। আমার ভাই বলে প্রশংসা করছি না। তিনি আসলেই একজন ভাল মানুষ। মশহুদ আহমদ নিজের কাজের জন্য কখনও আমাকে কিছু বলেননি। তবে মাদরাসার উন্নয়নের জন্য তিনি বারবার আমার কাছে যেতেন। ওনার (মশহুদ আহমদ) সন্তানরা দেশ ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এখন চাকরী করছে। তিনি এখন অবসরে যাচ্ছেন কিন্তু তিনি এই এলাকারই সন্তান। আশা করি সুবিধাজনক সময়ে এখনও তিনি মাদরাসার জন্য কাজ করবেন। 

তিনি বলেন, আপনারা যেহেতু এই মাদরাসাকে আলিম পর্যায়ে উন্নীত করতে চান সে জন্য সচিব বরাবর একটি আবেদন দেন আমি সেটি দেখব। সরকারের যদি কোনো জটিলতা না থাকে তা হলে আমি এটি দ্রুত সময়ের মধ্যে পাস করিয়ে নিয়ে আসবও। আপনাদের ভবনের কাজ কেন দেরি হচ্ছে আমি এ ব্যাপারে আগামীকালই খোঁজ নিব। 

ছাতক উপজেলার চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম কিরণ বলেন, আমার অত্যান্ত শ্রদ্ধাভাজন চাচা কাজী মশহুদ আজ অবসরে যাচ্ছেন। একজন গুণী শিক্ষক হিসেবে আমরা সবসময় চাচাকে সম্মান করতাম। শিক্ষার্থীদের জন্য তার নিবেদন আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো। সবসময় তিনি আমার ও আমাদের পরিবারের শুভাকাঙ্কী। 

উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী মাও.আব্দুস সামাদ বলেন, আমার অত্যান্ত প্রিয় বড় ভাই ও অভিভাবক আজ শিক্ষকতা থেকে অবসরে যাচ্ছেন। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। তার সহজ সরল জীবন আমাকে সবসময় মুগ্ধ করতো। সুনামগঞ্জ জেলার কাজী সমিতিতেও তিনি অত্যান্ত শ্রদ্ধার পাত্র। 

এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন উত্তর খুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন, অ্যাভোকেট শামসুর রহমান, মাওলানা মাহবুবুর রহমান তাজুল প্রমুখ। মাদ্রাসার শিক্ষক ইমাদ উদ্দিনের সঞ্চালনায় ও মাদ্রাসার গভনিং বডির সভাপতি আরশ আলী খান ভাসানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আবু তৈয়ব মোহাম্মদ শামসুন নূর। এ সময় মাদ্রাসার শিক্ষক, এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। পরে মাদ্রাসার ২০২৪ সালের দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কৃতি শিক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। 


এএফ/০১