বিদায় জামাল ভাই..

কাওসার চৌধুরী, খ্যাতিমান অভিনেতা


অক্টোবর ১২, ২০২৪
০১:১৫ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ১২, ২০২৪
০৫:৫৩ অপরাহ্ন



বিদায় জামাল ভাই..

টিভি নাটকের ছবিগুলো সেই সময়ে বিটিভির স্থির চিত্রগ্রাহক শাহীন ভাইয়ের তোলা।


আমাদের প্রিয় জামাল ভাই আর নেই! 

গতকাল সন্ধ্যা ছ’টার (স্থানীয় সময়) দিকে অভিনেতা-নির্দেশক জামাল উদ্দিন হোসেন কানাডার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। 

তাঁর পুত্র তপু’র একটি মেসেজে জেনেছি- জামাল ভাই যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা থেকে কানাডায় গিয়েছিলেন তপুর (পুত্র) সাথে সময় কাটাতে। সেখানেই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এই সময় স্থানীয় একটি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয় চিকিৎসার জন্য। 

ডাক্তারদের মতে- 

জামাল ভাই শক্তিশালী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। শ্বাসকষ্ট  হচ্ছিল বেশ! তাঁকে এ সময়ে ‘ভেন্টিলেশনে’ রাখা হয়। ১৮ দিন ভেন্টিলেশনে রাখার পর ডাক্তাররা জামাল ভাইয়ের ফিরে আসার আশা ছেড়ে দেন। খুলে নেয়া হয় ‘ভেন্টিলেশনে'র সকল যন্ত্রপাতি! তিনি মৃত্যু বরণ করেন। 

সত্তর দশকের মাঝামাঝি কোন একটি সময়ে জামাল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। পরে জামাল ভাইসহ অন্যান্যদের সাথে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায় ’৮৫ সালে- আমি ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে’ যোগ দেবার পর। এরপরে সু-দীর্ঘ স্মৃতি, সুদীর্ঘ সময় একসাথে পার করেছি একটি ‘পরিবারের সদস্যদের’ মতো। 

আশির দশকের শেষভাগে কোন একদিন জামাল ভাইয়ের মা অসুস্থ হয়ে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি হন। মাতৃভক্ত জামাল ভাই হাসপাতালে মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। এদিকে নাগরিকের ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকের মঞ্চায়নের তারিখ নির্ধারিত ছিল তার একদিন পরেই। মহিলা সমিতি মিলনায়তনের (সেদিনের) প্রায় সকল টিকিট বিক্রী হয়ে গিয়েছিল এরমাঝেই। ফলে খুব সহজে ‘নাটকের প্রদর্শনী’ও বাতিল করা যাচ্ছিল না! 

জামাল ভাই ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে (দারোগা) অভিনয় করতেন। কিন্তু তিনি হাসপাতালে মায়ের সেবায় ব্যস্ত থাকায় ‘অগত্যা’ আমাকেই ওই চরিত্রে ‘বিকল্প’ হিসেবে দাঁড় করানো হলো! শুধুমাত্র একদিনের প্রস্তুতিতে আমি একদিন পরে ওই নাটকে জামাল ভাইয়ের চরত্রটিতে অভিনয় করি। সে অভিনয় কেমন হয়েছিল, কতখানি সফল কিংবা বিফল- সে আলোচনা করার সময় আজ/এটা নয়। 


নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে একটি নিয়ম আছে; যে পারফরমার কোন কারনে কারো ‘বিকল্প’ হিসেবে অভিনয় করবে- তাকে পরপর (consecutive) ৩টি প্রদর্শনীতে অভিনয় করার সুযোগ প্রদান করা হয়। আমিও সে সুযোগ পেয়েছিলাম। 

এরমধ্যে জামাল ভাই একদিন মিলনায়তনে বসে আমার পারফরমেন্স দেখলেন আমার অজ্ঞাতসারে! নাটকশেষে ‘গ্রীণ রুমে’ এসে জামাল ভাই ঘোষণা করলেন- ‘এখন থেকে এই নাটকে দারোগা চরিত্রটি কাওসারই পারফরম করবে। পরিচালক আলী যাকেরের কাছে এটাই আমার প্রস্তাব’। আলী যাকেরও মেনে নিলেন জামাল ভাইয়ের সিদ্ধান্ত। গ্রীণ রুমে উপস্থিত সবাই করতালি দিয়ে স্বাগত জানালো আমাদের দু’জনকেই। আমি পা ছুঁয়ে সালাম করে জামাল ভাইয়ের আশীর্বাদ নেই। সেই থেকে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকে আমার নিয়মিত অভিনয়ের যাত্রা শুরু। 

দেশে এবং দেশের বাইরে আমি এই নাটকে পায় দেড়-দু’শ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছি। এই নাটকের বাইরে নাগরিকের আরো নাটকে অংশ নিয়েছি- সেটা ভিন্ন কাহিনী! কিন্তু ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকে এই অসাধারণ মজার চরত্রটিতে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম- আমাদের প্রিয় জামাল ভাইয়ের কল্যাণেই। আমি জামাল ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। 

বিটিভিতে বেশক’টা নাটকে জামাল ভাইয়ের সাথে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরমধ্যে সিরিজ নাটক ‘বড় বাড়ি’ এবং খণ্ড নাটক ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ এবং মমতাজ উদ্দিন আহমেদের লেখা নাটক 'নিকটে সমুদ্র'র কথা এই মুহুর্তে মনে আসছে। 


জামাল ভাইয়ের পুরো নাম জামাল উদ্দিন হোসেন। জন্ম ১০ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এ অভিনয় করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। নাগরিকের নাটক- সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিসসা, কবর দিয়ে দাও, অচলায়তন, বিসর্জন, ঈর্ষা-সহ আরো বেশক’টি নাটকে অভিনয় করেছেন। নব্বই দশকের শেষভাগে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করেন স্থায়ীভাবে। এই সময়ে তিনি বাংলাদেশের নাট্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন অনেকটাই। 

জামাল ভাই পেশায় ছিলেন একজন প্রকৌশলী। তাঁর স্ত্রী- রওশন আরা হোসেন ছিলেন একই নাট্য দলে সহ-শিল্পী, সহযোদ্ধা। তিনিও এ দেশের নামকরা একজন অভিনয় শিল্পী। জামাল ভাই এক ছেলে এবং এক মেয়ের জন্মদাতা। 

অভিনয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্র জামাল উদ্দিন হোসেনকে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা- ‘একুশে পদক’এ ভূষিত করে। 

জামাল ভাই, যেখানে যাচ্ছেন- 

ওখানে অনেক ভালো থাকুন আপনি। খুব মিস করবো আপনাকে। আপনাদের বিদায়ে চারপাশটা খুব শুন্য শুন্য লাগে। তবুও ভালো থাকুন ওখানে। বিদায়! 


কাওসার চৌধুরী: একুশে পদক প্রাপ্ত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা, দেশবরেণ্য অভিনেতা, কলাম লেখক ও প্রযোজক 



এএফ/০৫