নিজস্ব প্রতিবেদক
জুন ০৬, ২০২০
০৯:৪৮ অপরাহ্ন
আপডেট : জুন ০৬, ২০২০
১০:০৫ অপরাহ্ন
করোনা-পরিস্থিতিতে সিলেটের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের সেবা না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েকদিনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট আরও তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়ছেন কোভিড-১৯ আক্রান্ত নন, এমন সব ধরনের রোগী। চিকিৎসা না পেয়ে গত ছয় দিনের ব্যবধানে পর পর চারটি মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ মানুষেরা চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অলিখিতভাবে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে। এটি একটি চরম অমানবিক বিষয়। অথচ স্থানীয় প্রশাসন কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগ এ নিয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার ভোর পাঁচটায় শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে তিনটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজী ইকবাল হোসেন (৫৫)। একইভাবে গত বৃহস্পতিবার জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আখতার হোসেনের স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় চারটি হাসপাতাল ঘুরেও কোথাও তাঁকে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া গত ৩১ মে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে স্ট্রোক করে সিলেটে চিকিৎসা নিতে আসা এক নারীকে (৭০) ভর্তি করাতে সাতটি হাসপাতাল ঘুরেও পারেননি স্বজনেরা। এ তিনজনের বাইরে সিলেট নগরের আরও একজন ব্যক্তি চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন রোগীর পরিবারের অভিযোগ, অনেক বেসরকারি হাসপাতালে সেই অর্থে কোনো চিকিৎসাই এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে বিশেষত হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, জ্বর, হাঁপানি-শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, কাশি, লিভার ও কিডনির রোগের উপসর্গজনিত কোনো রোগীকে বিন্দুমাত্র চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সাধারণ রোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। গর্ভবতী নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রেও এ ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেকটা বেশি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য টেলি-মেডিসিন সেবা দেওয়া হচ্ছে। নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আবু বকর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এমনটা কখনোই করতে পারেন না। কিছু ব্যতিক্রম বাদে সাধারণ রোগের চিকিৎসাও এখন হাসপাতালগুলোতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে চিকিৎসকদের আরও মানবিক হওয়া প্রয়োজন।’
সচেতন নাগরিকদের অভিযোগ, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে সাধারণ রোগীদের ভর্তি নেওয়া তো দূরের কথা, চিকিৎসা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। অনেক অসুস্থ মানুষ চিকিৎসার জন্য একের পর এক হাসপাতালে ছুটে গিয়েও সেবা পাচ্ছেন না। কিছু সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে সেবা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল শনিবার দুপুরে নগরের জেলরোড এলাকায় সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সম্মেলন কক্ষে সিলেটের সুধীজনেরা এক বৈঠক করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ (মহানগর ও সদর) আসনের সংসদ সদস্য এ কে আবদুল মোমেনের কাছে বেশকিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন। বৈঠক থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সিলেটে দ্রুততম সময়ে বেসরকারি পর্যায়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা চালু, বেসরকারি হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে গেলে যাতে কেউ দুর্ভোগের শিকার না হন সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, সিলেটে করোনা শনাক্তের পরীক্ষাগার বৃদ্ধি করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নমুনার ফলাফল প্রদান এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনে করোনা ইউনিট চালু ও চলমান স্বাস্থ্যসেবাকে আরও গতিশীল করার অনুরোধ জানানো হয়। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠকে যোগ দিয়ে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এ সময় চিকিৎসা না পেয়ে নন-কোভিড রোগীর মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা না পেয়ে নন-কোভিড রোগীদের মৃত্যুর ঘটনায় সিলেটে প্রতিবাদ চলছে। বেশ কয়েকটি সংগঠন এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে গতকাল শনিবার বিকেলে প্রতীকি কফিন হাতে নগরে মিছিল করেছে সামাজিক সংগঠন ‘পাবলিক ভয়েস’। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সিলেট জেলা শাখার সমন্বয়ক আবু জাফর বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে দ্রুত সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।
এদিকে অনেকেই জানিয়েছেন, করোনার সংক্রমণ সিলেটে গত পাঁচদিন ধরে ক্রমশ বেড়েই চলছে। অথচ করোনা রোগীদের চিকিৎসায় পর্যাপ্ত সুবিধা সিলেটে নিশ্চিত করা যায়নি বলে অনেকেই মনে করছেন। সিলেট বিভাগে করোনা চিকিৎসার একমাত্র সরকারি হাসপাতাল শহীদ শামুসদ্দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের হাসপাতালটি ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ছিল। তবে করোনার কারণে নির্দিষ্ট দূরত্ব নিশ্চিত করতে এখানে ৮৫টি শয্যায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) রয়েছে ১৮টি। সবমিলিয়ে মোট শয্যা রয়েছে ১০৩টি। এ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর রয়েছে ১৮টি।
একই সূত্রে জানা গেছে, শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে মোট রোগী ভর্তি রয়েছেন ৭৩ জন। এর মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫২ জনের। বাকিদের করোনার উপসর্গ রয়েছে। এ ছাড়া আইসিউতে মোট ৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আরএমও সুশান্ত কুমার মহাপাত্র বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব রোগীরা হাসপাতালে আসছেন, তাঁদের যথাযথভাবে আমরা সেবা দিতে পারছি। রোগী বাড়লে কি করা হবে, তা নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের।’ এদিকে করোনা চিকিৎসার একমাত্র বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের একটি ভবনে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ইউনিট তাদের চালু হয়েছে। সেখানে ২০টি আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমান সিলেট মিররকে বলেন, ‘৫০ শয্যার বেশি সিলেটের সকল বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ চিকিৎসা না পেলে আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। আমরা প্রমাণ পেলে অভিযুক্ত হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরও জানান, কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে করোনার উপসর্গ থাকায় রোগীদের চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ রোববার করোনা প্রতিরোধের লক্ষে গঠিত সিলেট বিভাগীয় কমিটির বৈঠক আছে। সেখানে এসব বিষয়ে আলোচনা হবে।
এএন/বিএ-০১