করোনাযুদ্ধে নিরলস ছুটছেন গোলাপগঞ্জের স্বাস্থ্যকর্মীরা

ফারহান মাসউদ আফছর, গোলাপগঞ্জ


জুন ০৮, ২০২০
০৯:১৯ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ০৯, ২০২০
০৮:০২ অপরাহ্ন



করোনাযুদ্ধে নিরলস ছুটছেন গোলাপগঞ্জের স্বাস্থ্যকর্মীরা

বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সারাদেশের মতো সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলায় এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ৮৬৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫৭ জন করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ জন মারা গেছেন, সুস্থ হয়েছেন ১৯ জন এবং হোম আইসোলেশনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩৮ জন।

এই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও আক্রান্তদের সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, ল্যাব টেকনোলজিস্ট, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের চিকিৎসা প্রদান, নমুনা সংগ্রহ, ওষুধ পৌঁছে দেওয়া এবং সুস্থ্ হওয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখায় তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, ল্যাব টেকনোলজিস্টদের এই আন্তরিক সেবায় অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের করোনাযোদ্ধা, মানবিক ডাক্তার, সাহসী ডাক্তারসহ বিভিন্ন নামে অভিহিত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, সেবা প্রদান আমাদের কর্তব্য। করোনার এই কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যথাযথভাবে রোগীদের প্রদান সেবা অব্যাহত রেখেছি। যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে চারজন ব্যতিত সবাই বাড়িতে থেকেই সুস্থ হয়েছেন এবং হচ্ছেন।

করোনাজয়ী পৌরসভার টিকরবাড়ি গ্ৰামের রুনেল আহমদ জানান, তিনি করোনা পজিটিভ হওয়ার পর থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা তাকে চিকিৎসা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবরকম সহযোগিতা দিয়েছেন। কখনও নিজেকে একা বা অসহায় মনে হয়নি। এজন্য তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা  প্রকাশ করেন।

উপজেলার কোনো জায়গায় যে কারও মাঝে করোনার উপসর্গ দেখা দিলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টিম নমুনা সংগ্রহ করতে ছুটে যাইয়। এই মেডিকেল টিম করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই করোনা আক্রান্ত রোগীর নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ  ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তারা ব্যক্তিস্বার্থ আর নিরাপত্তার চেয়ে মানবিক দায়িত্বকেই বেছে নিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকির মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পেশাগত প্রতিশ্রুতি পালনের। আজকের এ জাতীয় দুর্যোগে মানুষের বিপদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। জীবন বাজি রেখে তারা মানুষের জন্য লড়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালের দায়িত্ব ছাড়াও মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যসেবার মহান দায়িত্ব পালন করছেন চিকিৎসকরা।

এভাবে মানুষের পাশে দেবদূতের মতো নিজের জীবন বিপন্ন করে মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা, তা চিরকাল মনে রাখবে গোলাপগঞ্জ উপজেলার মানুষ। আর মহামারীর এই কঠিন সময়ে দায়িত্বপালনে নানা প্রতিকূলতা থাকলেও সেবা দিতে পেরেই গর্বিত স্বাস্থ্যকর্মীরা।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মাসুদ আহমেদ বলেন, করোনাভাইরাস গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ার পর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিসর চৌধুরীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, অফিস স্টাফ ,ওয়ার্ড বয়, স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য সহকারী, সিএইচসিপি, এমএলএসএস সহ সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পেশাগত দায়িত্বপালনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস সারাদেশের মতো গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত সবাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেশাগত প্রতিশ্রুতি পালনের মধ্য দিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে আমাদের এ ছুটে চলা মানবতার তরে।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু ছাত্রজীবন থেকেই দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম। তাই আজকের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র পেশাদারিত্বের দায় থেকে নয়, সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করার দায়বদ্ধতা থেকে আমি এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে উৎসাহিত হই। করোনাযুদ্ধে সমাজ ও দেশের জন্য কাজ করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমি যতক্ষণ সুস্থ থাকব, ইনশাআল্লাহ যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি আমার দায়িত্বপালন করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হবো না।

গোলাপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইউনুছ চৌধুরী বলেন, গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম প্রশংসনীয়। স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ সংকট মোকাবেলায় নিজের অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

উপজেলার রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী মিজানুর রহমান চৌধুরী রিংকু বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে ঝুঁকির মধ্যে থেকেও সরকারের দেওয়া নির্দেশে গোলাপগঞ্জ উপজেলার জনসাধারণের মাঝে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। দিন-রাত সাধারণ রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার পাশাপাশি করোনা আক্রান্ত রোগীদের গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে তাদের বাড়িতে। তাদের এ সেবা কার্যক্রম সত্যি প্রশংসনীয়। এমন সেবা কার্যক্রম নিয়মিত অব্যাহত রাখার জন্য অনুরোধ করছি।

বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার প্লান্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সমাজসেবক মনজুর সাফি চৌধুরী এলিম বলেন, করোনা একটি বৈশ্বিক দুর্যোগ। এই দুর্যোগকালীন সময়ে আমি মনে করি স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িত প্রত‍্যেকেই একেকজন সম্মুখযোদ্ধা। বিশেষ করে ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই করোনা মোকাবেলায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সমগ্র দেশের ন্যায় আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার ও নার্স থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জড়িত প্রত‍্যেকে অত‍্যন্ত সাহস ও আন্তরিকতার সহিত কাজ করছেন, যা প্রশংসার দাবিদার। আমি সর্বদা তাদের সুস্থতা কামনা করি। আমি আমাদের প্রত‍্যেক নাগরিকের প্রতি অনুরোধ করব, আমাদের সচেতনতাই আমাদেরকে সুরক্ষা দিতে পারে। তাই সচেতনতা ও সাহসের সহিত এই সংকট আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (আবাসিক) ডা. শাহিনুর ইসলাম শাহিন বলেন, আমরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যারা কর্মরত আছি, তারা সবাই করোনা সংকট মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছি। আপনারা দেখছেন আমরা সম্মেলিতভাবে মাঠে-ময়দানে রোগীদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছি এবং এর জন্য আমাদেরকে সবাই সাধুবাদ জানাচ্ছে। এর জন্য সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মনিসর চৌধুরী মহোদয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও দিকনির্দেশনায় আমরা সবাই কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত  উপজেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা শুন্যতে নেমে না আসবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সহিত দায়িত্বপালন করে যাব। আমি আশা করছি উপজেলাবাসীকে যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারব।

এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনিসর চৌধুরী বলেন, করোনার এই কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যথাযথভাবে রোগীদের সেবা অব্যাহত রেখেছি। সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চারজন স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা যারা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এ মানব সেবার ব্রত নিয়ে এ পেশায় এসেছি, যেকোনো দুর্যোগের সময় মানুষের সেবা প্রদান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করি। তাই জাতির এমন সংকটময় মুহূর্তে যথাসম্ভব সচেতন থেকে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে মহামারী আকার ধারণ করেছে। এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সচেতনতাই একমাত্র অবলম্বন। স্বাস্থ্য সচেতনতাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি মাস্ক ব্যবহার করতে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সচেতন হওয়ার জন্য জনসাধারণকে অনুরোধ করেন।

 

এফএম/আরআর-০১