ওসমানীনগরে প্রবাসীর পাসপোর্ট ছিনতাইয়ের ঘটনাটি পরিকল্পিত

বালাগঞ্জ প্রতিনিধি


সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০
০৮:৪৯ অপরাহ্ন


আপডেট : সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০
১১:০১ অপরাহ্ন



ওসমানীনগরে প্রবাসীর পাসপোর্ট ছিনতাইয়ের ঘটনাটি পরিকল্পিত
পিবিআই'র তদন্ত প্রতিবেদন

যুক্তরাজ্য প্রবাসী হাফিজ এম ডি ইউনুছ আলী ও তার স্ত্রী দিলারা খানমের দু’টি বৃটিশ পাসপোর্ট, ৩০ হাজার টাকা, দেড় হাজার ইউরো পাউন্ড, ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট চেকের পাতা, চেক বই, বাসাবাড়ি ও জমির দলিলপত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিনতাই হয়েছিল। ওই ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে জানিয়েছে পিবিআই'র তদন্ত প্রতিবেদন।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউনুছ আলী ও তার ভাতিজা নজির আহমদ ওসমানীনগরের গোয়ালাবাজার থেকে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে সিলেট শহরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলে পথিমধ্যে তারা ছিনতাইয়ের শিকার হন। ওইদিন বেলা আড়াইটার দিকে তারা সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের কাশিকাপন এলাকায় পোঁছামাত্র একটি মোটরসাইকেলে করে তিনজন ছিনতাইকারী এসে তাদের বহনকারী অটোরিকশার গতিরোধ করে। ছিনতাইকারীরা তাদেরকে ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ইউনুছ আলীর হাতে থাকা ব্যাগটি ছিনিয়ে নেয়।

ওই ঘটনায় ইউনুছ আলী বাদী হয়ে ঘটনার দিন ওসমানীনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরির আবেদন করেন। এরপর ইউনুছ আলীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২২ ফেব্রুয়ারি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নং-১৭)। এরপর অধিকতর তদন্তের জন্য ২০১৯ সালের ৭ জুলাই এই মামলাটি সিলেট পিবিআই'র কাছে হস্তান্তর করা হয়। পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) রুপক কুমার সাহা মামলাটি তদন্ত করে সাতজনকে অভিযুক্ত করে চলতি বছরের ১১ মার্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে অভিযুক্তরা হলেন- ওসমানীনগর উপজেলার উছমানপুর ইউনিয়নের ধনপুর গ্রামের মোজাম্মেল আলীর ছেলে কাইয়ুম আহমদ, আব্দুর রহমানের ছেলে জুনেদ আহমদ, একই উপজেলার মোহাম্মদপুর-রাইগদাড়া গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে তুরণ মিয়া, বাজিতপুর গ্রামের ফিরুজ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী, দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সিকান্দার আলীর ছেলে মইন উদ্দিন ওরফে মইন, এসএমপি'র এয়ারপোর্ট থানার মংলীপাড়া গ্রামের জহির উল্যার ছেলে খলিল উল্যা ও শরিয়তপুর জেলার জাজিরা থানার মান্নান মল্লিকের কান্দি (চিটার চর) গ্রামের ইউনুছ মাতব্বরের ছেলে মোহাম্মদ আলী ওরফে মোল্লা। মোহাম্মদ আলী ওরফে মোল্লার বর্তমান ঠিকানা সিলেট নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের গোটাটিকর খান বাড়ি ও এয়ারপোর্ট থানার মংলীরপাড় নেছারাবাদ হাউজিং উল্লেখ করা হয়েছে। 

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওসমানীনগর উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী ইউনুছ আলী তার আপন মামাতো বোন একই উপজেলার ধনপুর গ্রামের মোজাম্মেল আলীর মেয়ে তাসলিমা বেগম সুপাকে (২য় স্ত্রী) বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে সুপার বড় ভাই কাইয়ুম আহমদ ভগ্নিপতি ইউনুছ আলীর বাসা ভাড়া আদায়সহ সহায়-সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্বপালন করছিলেন। ভগ্নিপতির টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হন কাইয়ুম। এদিকে সুপা স্বামীর নামে থাকা ওসমানীনগরের তাজপুরস্থ বাসার জমি হেবা দলিল করে নিয়ে বাসা নির্মাণ করেন। এমতাবস্থায় বিয়ের প্রায় ১০ বছর পর স্বামীকে একতরফা তালাক দিয়ে পুরাতন প্রেমিক জুনেদ আহমদকে গোপনে বিয়ে করেন সুপা। বিয়ের পর সুপার ভাই কাইয়ুম ও প্রেমিক স্বামী জুনেদের মধ্যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং মামলার শিকার হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইউনুছ আলীকে ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত করার জন্য কাইয়ুম, জুনেদ, মোহাম্মদ আলী ও অটোরিকশাচালক তুরণ ফন্দি আঁটেন। তারা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে মইন উদ্দিন ওরফে মইন এবং তার দুই সহযোগী খলিল উল্যা ও মোহাম্মদ আলী ওরফে মোল্লাকে ভাড়া করে ইউনুছ আলীর পাসপোর্টসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিনতাই করান। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অভিযুক্ত মইন উদ্দিন ওরফে মইন, খলিল উল্যা ও মোহাম্মদ আলী ওরফে মোল্লার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তুরণের বিরুদ্ধে ওসমানীনগর থানায় একটি মামলা রয়েছে।

এদিকে ওসমানীনগর থানায় মামলা দায়েরের পর ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে অটোরিকশাচালক তুরণ মিয়াকে আটক করে পুলিশ। তুরণের দেওয়া তথ্যমতে মোহাম্মদ আলী ও মইন উদ্দিন ওরফে মইনকে আটক করা হয়। আটকের পর মইনের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ছিনতাই করে নেওয়া ৩০ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে মইন জনসম্মুখে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়। তার দেওয়া স্বীকারোক্তির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। মইন স্বীকারোক্তিতে জানায়, কাইয়ুম ও জুনেদের পরিকল্পনায় ছিনতাইয়ের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ছিনতাই হওয়া পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কাইয়ুম-জুনেদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

মইনের স্বীকারোক্তির বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পরও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সাইফুল মোল্লা ও ওসি এস এম আল মামুন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রভাবিত হয়ে মূল পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় না এনে রহস্যজনক আচরণ করেন বলে বাদীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।  পুলিশের এমন রহস্যজনক আচরণের বিষয়টি উল্লেখ করে মামলার বাদী ইউনুছ আলীর ভাতিজা নজির আহমদ পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট লিখিত অভিযোগ দেন। লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর তিন দফায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হলেও মূল পরিকল্পনাকারীরা অধরা থেকে যায়।

মামলার বাদী ইউনুছ আলীর ভাতিজা নজির আহমদ বলেন, 'আমি এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে আছি। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর করোনার কারণে দীর্ঘদিন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল, তাই তদন্ত প্রতিবেদন হাতে আসতে বিলম্ব হয়েছে। থানায় মামলা দায়েরের পর তিনজন আসামি আটক হলেও রহস্যজনক কারণে পুলিশ আদালতে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের কোনো আবেদন করেনি। এছাড়া পুলিশ মূল পরিকল্পনাকারীদের আইনের আওতায় আনেনি। ছিনতাই হওয়া পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্রও উদ্ধার না করে পুলিশ উল্টো আমাকে নানাভাবে হয়রানি করেছে। পুলিশের উপর আস্থা রাখতে না পেরে নিরুপায় হয়ে পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আবেদন করলে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। আশা করেছিলাম পিবিআই মূল হোতাদের আটক করলে ছিনতাই হওয়া পাসপোর্ট ও কাগজপত্র উদ্ধার হবে, কিন্তু তা হলো না। ছিনতাইয়ের ঘটনার পরিকল্পনাকারীরা আটক না হওয়ায় আইনের সুযোগ নিয়ে তারা দম্ভ করে বেড়াচ্ছে। এখন ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের দিকে চেয়ে আছি।'

 

এসএ/আরআর-০৮