ফসলরক্ষা বাঁধ : সাত মাসেও মিলেনি টাকা, এলাকাছাড়া পিআইসি

সালেহ আহমদ, ধর্মপাশা


অক্টোবর ২১, ২০২০
০৬:১০ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২১, ২০২০
০৬:১০ অপরাহ্ন



ফসলরক্ষা বাঁধ : সাত মাসেও মিলেনি টাকা, এলাকাছাড়া পিআইসি

 

হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সদস্যরা এখনও চতুর্থ কিস্তির (চূড়ান্ত বিল) টাকা পাচ্ছেন না। প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে অনেক পিআইসি সদস্যকে ধার-দেনা করতে হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় অনেক পিআইসি সদস্যকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।  এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

উপজেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ধর্মপাশা উপজেলায় চন্দ্র সোনার থাল, কাইলানী, ঘোড়াডোবা, জয়ধনা, গুরমা, সোনামড়ল, ধানকুনিয়া ও গুরমার বর্ধিতাংশ এই ৮টি হাওর সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে রয়েছে। এই ৮টি হাওরপাড়ের কৃষকদের নিয়ে ১৭৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়। এ কাজের জন্য বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে তাদেরকে দেওয়া হয়েছে ২১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। 

নীতিমালা অনুযায়ী গতবছরের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করে তা চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে বাঁধের কাজ সম্পন্ন হয়েছে চলতি বছরের ১৫ মার্চ। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে চূড়ান্ত বিল (চতুর্থ কিস্তির) টাকা পরিশোধ করার জন্য উপজেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ কমিটি সভা করে। কমিটির পক্ষ থকে সুনামগঞ্জ জেলা কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ কমিটির কাছে গত ২৫ মে একটি প্রতিবেদনও পাঠানো হয়। কিন্তু পিআইসি সদস্যদের অবশিষ্ট চতুর্থ কিস্তির পাওনা প্রদান করার বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি।  

উপজেলার গুরমার বর্ধিতাংশ হাওরের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসির) সভাপতি লেলিন সরকার বলেন, 'আমাদের প্রকল্পটিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ১৬ লাখ ২৮ হাজার টাকা। আমরা পেয়েছি মাত্র ৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। বাঁধের কাজ করতে গিয়ে ৫ লাখ টাকা সুদের উপরে ঋণ করেছি। বাঁধের প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার সাত মাস অতিবাহিত হলেও এখনও চতুর্থ কিস্তির (চূড়ান্ত বিল) টাকা আমরা পাইনি। ফলে পাওনাদারদের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় তাদের সীমাহীন চাপ সইতে না পেরে অতিষ্ঠ হয়ে গত তিন-চার মাসের বেশি সময় ধরে এলাকা ছেড়ে আমাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের রেখে এভাবে আর কতদিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে তা উপরওয়ালাই জানেন।'

উপজেলার চন্দ্র সোনার থাল হাওরের দয়ালপুর গ্রামের সামনে থাকা ফসলরক্ষা বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি শামীমা আক্তার বলেন, 'ঋণ করে টাকা এনে সাত মাস আগে কাজ শেষ করেছি। এখনও চতুর্থ কিস্তির টাকা পাইনি। পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় নানা কটু কথা শুনতে হচ্ছে। দ্রুত চতুর্থ কিস্তির টাকা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।'

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের ধর্মপাশা উপজেলা কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক কৃষক আলা উদ্দিন বলেন, 'এবার বোরো মৌসুমে ধর্মপাশা উপজেলায় হাওরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কোনোরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াই হাওরের সোনার ফসল (ধান) কৃষকেরা গোলায় তুলতে পেরেছেন। ফসলরক্ষা বাঁধের কাজও ভালোভাবে শেষ হয়েছিল। কিন্তু কাজ সম্পন্ন হওয়ার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরা (কৃষকেরা) চতুর্থ কিস্তির চূড়ান্ত বিল পাননি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখ ও হতাশাজনক। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ সমস্যা সমাধানে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।'

তিনি আরও বলেন, 'অবশিষ্ট পাওনা চতুর্থ কিস্তির প্রাপ্য টাকা পেতে গিয়ে পিআইসি সদস্যরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন তাতে আগামীতে অনেক কৃষকই প্রকল্প কমিটিতে থাকতে চাইবেন না। এতে করে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে।'

সুখাইড় রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, 'হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও চতুর্থ কিস্তির টাকা পিআইসিদের এখনও পরিশোধ করা হয়নি। ফলে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঋণ করে আনা টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পেরে পাওনাদারদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আমার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব অনেকদিন ধরে এলাকাছাড়া রয়েছেন। দ্রুত চতুর্থ কিস্তির অবশিষ্ট টাকা দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।'

এ বিষয়ে ধর্মপাশার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনতাসির হাসান বলেন, 'চতুর্থ কিস্তির টাকা না পেয়ে এখানকার পিআইসি কমিটিতে থাকা সদস্যরা চরম বিপাকে রয়েছেন। আমি এ নিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।'

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, 'দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমি ও জেলা প্রশাসক মহোদয় বেশ কয়েকবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। আশার কথা হলো সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি ফসলরক্ষা বাঁধের কাজের চতুর্থ কিস্তির (চূড়ান্ত বিলের) অবশিষ্ট টাকা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়করণ হওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করছি চলতি মাসের মধ্যেই পিআইসিদের মধ্যে তাদের চূড়ান্ত বিলের (চতুর্থ কিস্তির) টাকার চেক বিতরণ করা সম্ভব হবে।'

 

এসএ/আরআর-০৩