সুনামগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও ধান-চাল সংগ্রহ হয়নি

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি


অক্টোবর ২৩, ২০২০
০৪:৪০ অপরাহ্ন


আপডেট : অক্টোবর ২৩, ২০২০
০৪:৪০ অপরাহ্ন



সুনামগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও ধান-চাল সংগ্রহ হয়নি

বোরো ভান্ডার হিসেবে পরিচিত হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে এ বছর বোরো মৌসুমে প্রকৃতির বদান্যতায় সম্পূর্ণ ফসল গোলায় উঠেছে। বাম্পার ফলনে কৃষকরা খুশি হলেও মৌসুমের শুরুতে ন্যায্য দাম পাননি কৃষকরা। তাই ওই সময় অল্প দামে ধান বিক্রি করতে হয়েছিল কৃষককে। এই সুযোগে ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, ব্রাম্মণবাড়িয়সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান ব্যবসায়ীরা হাওরে বড় বড় নৌকা নিয়ে এসে অল্প দামে ধান কিনে নিয়েছিলেন। গুদামে ধান দেওয়া কৃষকের তালিকায় জটিলতা, ভোগান্তি ও অনিয়মের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কৃষক ধান দিতে পারেননি।

তবে খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে, করোনাকালীন স্থবিরতা ও সরকারি মূল্যের চেয়ে বাজারদর বেশি থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। চুক্তিবদ্ধ ৩ শতাধিক চালকল মালিকের মধ্যে এক চতুর্থাংশও চুক্তির চাল দিতে পারেননি। ধানের দাম বেশি থাকার অজুহাত দেখিয়ে গুদামে চাল দেওয়া থেকে বিরত থাকেন তারা। অন্যদিকে মহাজনরা কৃষকের গোলা খালি করে আগেই ধান কিনে নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ধানের লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি খাদ্য বিভাগ।

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ধান সংগ্রহ করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু কৃষকের তালিকা তৈরিতে বিলম্ব, জটিলতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সময়মতো ধান সংগ্রহ শুরু করা সম্ভব হয়নি। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হয়েছে।

সংগ্রহে বিলম্বের কারণে জেলার বাইরের ব্যবসায়ীরা বড় বড় নৌকা নিয়ে হাওরের কৃষকের ধান কিনতে আসেন। তারা ৭০০-৮০০ টাকা মন দরে ধান ক্রয় করে কৃষকের অতিরিক্ত ধান কিনে নিয়ে যান। জুন মাসে যখন সরকারিভাবে ধান কেনা শুরু হয়, তখন বাইরের ব্যবসায়ীরা কৃষকের গোলা খালি করে অতিরিক্ত ধান কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাই কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্য বিভাগ আশানুরূপ সাড়া পায়নি। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বোরো ধান-চাল সংগ্রহের নির্ধারিত তারিখ ছিল। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। ওইসময় পর্যন্ত ৩২ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন ধানের মধ্যে খাদ্যবিভাগ ১৭ হাজার ১২২ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছিল। গড় সংগ্রহের হার ছিল ৫২ ভাগ। সিদ্ধ চাল ১৪ হাজার ৬৮৭ মেট্রিক টনের মধ্যে মাত্র ৩ হাজার ৮৮৪ মেট্রিক টন সংগ্রহ করা হয়েছিল। আতপ চাল ১৪ হাজার ৩০৯ মেট্রিক টনের মধ্যে ১২ হাজার ২৯৭ মেট্রিক টন সংগ্রহ করা হয়। চাল সংগ্রহের হার যথাক্রমে ২৬ ভাগ ও ৮৬ ভাগ। এদিকে সরকারের খাদ্য বিভাগ জেলার তিন শতাধিক চালকল মালিকের সঙ্গে চালের চুক্তি করলেও শতাধিক চালকল মালিক সরকারকে চুক্তির চাল দিতে পারেননি।

সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। করোনার মধ্যেও শিলাবৃষ্টি আর বন্যায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পুরো ধান কেটে গোলায় তুলেছিলেন কৃষকরা। জেলায় এ বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হয়েছে। সরকারি হিসেবে এই ধান থেকে প্রায় ১৩ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে, যার মধ্যে সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে বাকি ৮ লাখ মেট্রিক টন উদ্ধৃত্ত রয়েছে। খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান প্রথমে বিলম্বিত হয়েছে। তবে এর মধ্যেই বাইরের জেলার কৃষকরা ধান কিনে নিয়ে যাওয়ায় ঘরে বসে বাজারদরের চেয়ে ভালো মূল্য পাওয়ায় কৃষক ধান বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

এদিকে হাওর আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধান সংগ্রহ অভিযানের ত্রুটি, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে সংগ্রহ না করা, সংগ্রহে বিলম্ব ও কৃষকের চাহিদা প্রতিফলিত না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি বলে দাবি করেছেন।

শাল্লা উপজেলার কৃষক সংহতির আহ্বায়ক পীযুষ দাস বলেন, 'এবার হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন পরে এমন ফলনে খুশি ছিলাম। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের আগেই জরুরি প্রয়োজনে ঋণগ্রস্ত কৃষক ধান বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া জেলার বাইরের পাইকাররা বড় বড় নৌকা নিয়ে এসে ধান কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ধান সংগ্রহের তালিকায় জটিলতা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।'

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি প্রফেসর চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, 'গলদ রয়েছে ধান সংগ্রহ নীতিমালায়। আমরা স্মারকলিপি দিয়েছিলাম ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কৃষকের ধান উপযুক্ত সময়ে সংগ্রহ করার জন্য। সেটা যতদিন হবে না, ততদিন সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। আমাদের হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গমতার কারণেও কৃষকদের গুদামে এসে ধান দেওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া চালকল মালিকরা সরকারি চুক্তিবদ্ধ হয়েও চাল গুদামে দেননি। তারা বরাবরই এমনটি করেন। তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে না এলে কখনও লক্ষ্য পূরণ হবে না।'

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক নাকিব খান সাইফুল বলেন, 'আমি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হওয়ার ২-৩ দিন আগে এসেছিলাম। এবছর করোনার কারণে বিলম্ব এবং বাজারে ধানের মূল্য বেশি থাকায় সংগ্রহ আশানুরূপ হয়নি।'

 

এসএস/আরআর-০১