ভাষাসৈনিক শাহেদ আলীকে মনে রাখেনি কেউ!

আবির হাসান মানিক, তাহিরপুর


নভেম্বর ০৬, ২০২০
১১:৪৩ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ০৭, ২০২০
১১:১১ অপরাহ্ন



ভাষাসৈনিক শাহেদ আলীকে মনে রাখেনি কেউ!
প্রয়ান দিবসে নেই কোনো আয়োজন

ভাষাসৈনিক অধ্যাপক শাহেদ আলী

প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক, অমর কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলীর ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে প্রয়াতের জন্মভূমি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে নেই কোনো আয়োজন বা স্মৃতিচারণ।

প্রচার আর উদ্যোগের অভাবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এখন অপরিচিত ভাষা আন্দোলনের এ অগ্রসৈনিক। এমনকি নানা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান থাকলেও নিজ উপজেলা তাহিরপুরে তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে নেই কোনো উদ্যোগ। প্রখ্যাত এ ব্যক্তির স্মরণার্থে গড়ে ওঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান, তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে নেই কোনো পাঠাগার বা ট্রাস্ট। নিজ জন্মভূমি তাহিরপুরে আজও আড়ালেই রয়ে গেলেন এ গুণী ব্যক্তিত্ব।

বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, শাহেদ আলী গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ১৯৪২ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা (এসএসসি), ১৯৪৫ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ (এইচএসসি) ও ১৯৪৭ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪০ সালে ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত থাকাকালীন 'সওগাত' পত্রিকায় তাঁর সর্বপ্রথম গল্প 'অশ্রু' প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে তাঁর বিভিন্ন গল্প ও প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁকে বলা হতো জীবনধর্মী লেখক।

পেশাগত জীবনে তিনি ১৯৫১ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাছাড়া ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।

রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৫৪ সালে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যাপক শাহেদ আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইসলামিক একাডেমী) প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বপালন করেন।

চল্লিশের দশক থেকেই শাহেদ আলী সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। আর পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে ১৯৪৪-৪৬ সালে 'মাসিক প্রভাতি' এবং ১৯৪৮-৫০ সালে তিনি 'সাপ্তাহিক সৈনিক' পত্রিকা দু'টি সম্পাদনা করেন। ১৯৫৫ সালে 'দৈনিক বুনিয়াদ' সম্পাদনা করেন। ইসলামী ফাউন্ডেশনের বিখ্যাত শিশু মাসিক 'সবুজ পাতা' সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে 'দৈনিক মিল্লাত'র সহকারী সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্বপালন করেন। ১৯৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী পত্রিকা সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন।

তিনি ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। তাছাড়া অধ্যাপক শাহেদ আলী বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮-৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রমে জড়িত থাকা অধ্যাপক শাহেদ আলী তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্বপালন করেন।

তাঁর লেখার মধ্যে অন্যতম হলো, জিবরাইলের ডানা, একই সমতলে, অতীত রাতের কাহিনী, অমর কাহিনী, নতুন জমিনদার, শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প ও শাহেদ আলীর নির্বাচিত গল্প।

১৯৬৫ সালে প্রকাশ হওয়া উপন্যাস ছিল হৃদয় নদী আর নাটকের মধ্যে ছিল বিচার। তাঁর লেখা শিশুসাহিত্য হলো রূহীর প্রথম পাঠ। তাছাড়াও তাঁর গবেষণা গ্রন্থ হলো ছোটদের ইমাম আবু হানিফা, সোনারগাঁয়ের সোনার মানুষ, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান ইত্যাদি।

ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়েও অধ্যাপক শাহেদ আলী অনেকটা সময় পার করেছেন। এ বিষয়ে লেখাসমূহ হলো- তরুণ মুসলিমের ভূমিকা, একমাত্র পথ, তরুণের সমস্যা, তাওহীদ, মুক্তির পথ, বুদ্ধির ফসল আত্মার আশিস, ধর্ম ও , জীবন নিরবচ্ছিন্ন, জীবন দৃষ্টি সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি।

তিনি বেশকিছু বিদেশি লেখকের বই অনুবাদ করেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মক্কার পথ, ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার, আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ, ইতিবৃত্ত ইত্যাদি।

অধ্যাপক শাহেদ আলী ছোট গল্পের জন্য ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। তাছাড়া ভাষা আন্দোলন পদক, একুশে পদক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, জাসাস স্বর্ণপদক (মরণোত্তর), তমুদ্দন মজলিস, মাতৃভাষা পদক, কিশোর কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর) এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হোন।

মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার দাবিতে তৎকালীন সময়ে যে কয়জন সক্রিয় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক শাহেদ আলীও একজন। অধ্যাপক শাহেদ আলী ভাষা আন্দোলনের একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ভাষা আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রতিকূল পরিবেশে যারা নির্ভীক ভূমিকা পালন করেছেন, তিনি তাদের অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সৈনিক’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি যে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অধ্যাপক শাহেদ আলী ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে সুনামগঞ্জের হাওর জনপদ তাহিরপুর উপজেলার অন্তর্গত দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী ইসমাইল, মাতা আয়েশা খাতুন। ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর ৭৬ বৎসর বয়সে তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

এএইচ/আরআর-০৩