কানাইঘাটে দুইপক্ষের মিছিল, পুলিশসহ আহত অর্ধশতাধিক

কানাইঘাট প্রতিনিধি


নভেম্বর ০৯, ২০২০
১১:৪৮ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ১০, ২০২০
০১:১৩ পূর্বাহ্ন



কানাইঘাটে দুইপক্ষের মিছিল, পুলিশসহ আহত অর্ধশতাধিক

তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ সোমবার (৯ নভেম্বর) সকাল ৮টার দিকে কানাইঘাট চতুল ও ফালজুর পরগনার কয়েক হাজার লোকজন লাঠি-সোঁটা নিয়ে ঘোষণা দিয়ে কানাইঘাট বাজারের দিকে আসার পথে ফাঁকা গুলি, টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে এবং লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চতুল ও ফালজুর পরগনার সশস্ত্র লোকজন। এতে পুলিশের দুই সদস্যসহ অন্তত অর্ধশতাধিক লোক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

পুলিশ দাবি করেছে, চতুল-ফালজুর পরগনার লোকজন তাদের উপর হামলা করলে পুলিশ বাধ্য হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বেশ কিছু টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে এবং লাঠিচার্জ করে উশৃঙ্খল লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে নকলার ব্রিজ থেকে হকারাই পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার এলাকায় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।

এর আগে গতকাল রবিবার গভীর রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কানাইঘাট থানার পুলিশ চতুল ও ফালজুর পরগনার বেশ কয়েকজনকে আটক করলেও আজ সোমবার বিকেলে তাদের মুচলেকার বিনিময়ে থানা থেকে ছেড়ে দেয়।

জানা যায়, গত মঙ্গলবার কানাইঘাট বাজারের ব্যবসায়ী পৌরসভার দুর্লভপুর গ্রামের আলী আমজদের পুত্র আলী আকবরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মটরশুটির দরদাম নিয়ে তার সঙ্গে মারামারি হয় বড়চতুল ইউনিয়নের লখাইর গ্রামের শফিকের পুত্র মো. আব্দুল্লাহ'র। তাৎক্ষণিক কানাইঘাট থানার পুলিশ ও বাজার ব্যবসায়ী সমিতির হস্তক্ষেপে ঘটনাটি সালিশে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে লখাইর গ্রামের শফিকের পুত্র আব্দুল্লাহ'র পক্ষ নিয়ে চতুল ও ফালজুর পরগনার লোকজন তাদের এলাকায় কয়েক দফা বৈঠক করেন। এ ঘটনার জন্য তারা দুর্লভপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আলী আকবরকে চতুল এলাকায় গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলেন। তা না হলে এ দুই পরগনার লোকজন লাঠি-সোঁটা নিয়ে মারামারির ডাক দেবেন বলে জানান। তাদের এমন সিদ্ধান্তে আকবরের পক্ষ নিয়ে ঘটনাটি থানায় বসে নিষ্পত্তির জন্য চাউরা, বাজেরাজ ও সাতবাঁক পরগনার মুরুব্বিরা এলাকায় বৈঠক করেন। এতে পরগনা প্রথা নিয়ে এলাকায় দুইপক্ষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করলে আকবর ও আব্দুল্লাহ'র মধ্যে মারামারির ঘটনাটি পরগনাভিত্তিক না নিয়ে সামাজিকভাবে নিষ্পত্তির জন্য কানাইঘাট সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল করিম ও থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএম কয়েকদফা উভয় পরগনার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগসহ থানায় তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। কিন্তু চতুল ও ফালজুর পরগনার লোকজন আকবরকে তাদের এলাকায় গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে অনড় থাকলে নিষ্পত্তির বিষয়টি ভেস্তে যায়।

চতুল ও ফালজুর পরগনার লোকজন গতকাল রবিবার রাতে তাদের এলাকায় মাইকিং করে দুর্লভপুর গ্রামের লোকজনের বিরুদ্ধে মারামারির ডাক দেন। এতে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে রবিবার গভীর রাত থেকে র‌্যাবের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক পুলিশ এলাকায় মোতায়েন করা হয়। 

আজ সোমবার ভোর থেকে এই দুই পরগনার কয়েক হাজার লোক দেশীয় লাঠি-সোঁটা, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রথমে চতুল পরগনার দরবস্ত সড়কের হকারাই এলাকায় জমায়েত হতে থাকেন। সেখানে সিলেট জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তর মাহবুবুর রহমান, পুলিশের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, কানাইঘাট সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল করিমসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কানাইঘাট থানার ওসি শামসুদ্দোহা পিপিএমের নেতৃত্বে শতাধিক পুলিশ, র‌্যাব এবং জৈন্তিয়া ১৭ পরগনার মুরুব্বিরা তাদের ব্যারিকেড দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু হাজার হাজার লোকজন লাঠি-সোঁটা নিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে খেলুরবন্দ ইটভাটায় অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে তারা আবারও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে কানাইঘাট বাজারের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ নকলা ব্রিজের সামনে অবস্থান নিয়ে চতুল ও ফালজুর পরগনার লোকজনদের সরে যাওয়ার আহ্বান করেন।

পুলিশের দাবি, তখন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিলকারীরা পুলিশের উপর হামলা চালালে পুলিশ বাধ্য হয়ে ফাঁকা গুলি, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ছুড়ে এবং লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে কত রাউন্ড ফাঁকা গুলি, টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়েছে তা পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও জানানো হয়নি।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মাহবুবুর রহমান বলেন, '৩০ রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগজিন পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে তারা নিয়ে গেছে। ম্যাগজিন ও গুলি দ্রুত ফেরত দেওয়ার জন্য চতুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেন ও সাবেক চেয়ারম্যান মুবশ্বির আলী চাচাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'

এদিকে এলাকায় এ নিয়ে যাতে করে কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা ও মারামারির ঘটনা না ঘটে সেজন্য বেলা ৩টায় সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম ও সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন পিপিএম কানাইঘাটে এসে উপজেলা সম্মেলনকক্ষে জনপ্রতিনিধি, জৈন্তিয়া ১৭ পরগণার সালিশ কমিটির নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পরগণার মুরুব্বিদের নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে এ নিয়ে কোনো পক্ষ এলাকায় পুনরায় অশান্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এ ঘটনা নিষ্পত্তির জন্য শিগগির জৈন্তাপুর উপজেলার রাজবাড়িতে ১৭ পরগনা সালিশ কমিটির নেতৃবৃন্দ উভয়পক্ষের মুরুব্বিদের নিয়ে সামাজিকভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দেবেন বলে প্রশাসনকে আশ্বস্ত করেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মুমিন চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সুমী আক্তার, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম, জৈন্তাপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, ১৭ পরগনার সালিশ সমন্বয় কমিটির সভাপতি আবুল মওলা চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা জামাল উদ্দিন, বড়চতুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হোসেন, সাবেক চেয়ারম্যান মুবশ্বির আলী, লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জেমস্ লিও ফারগুসন নানকা, কানাইঘাট দিঘীরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী হোসেন কাজল, জৈন্তাপুরের দরবস্ত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহার প্রমুখ।

 

এমআর/বিএন-০৫/আরআর-০৩