চড়ুইভাতি তাঁদের নিয়ে গেল শৈশবে

এ.জে লাভলু, বড়লেখা


নভেম্বর ১৭, ২০২০
০৯:১০ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ১৭, ২০২০
০৯:১০ অপরাহ্ন



চড়ুইভাতি তাঁদের নিয়ে গেল শৈশবে

কেউ শিক্ষক, কেউ জনপ্রতিনিধি। আছেন ব্যাংকার, ছাত্র ও ব্যবসায়ী। তাঁরা সকলেই প্রতিষ্ঠিত। বিভিন্ন ভালো জায়গায় তাদের অবস্থান। ফলে কাজের চাপ ও নাগরিক ব্যস্ততা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে তাঁদের। সেই কবে জীবন থেকে দুরন্ত শৈশব ছুটি নিয়েছে। তবুও নিজেদের মনের ভেতরে পুষে রেখেছেন সবুজ শৈশব। গ্রামের মেঠো পথ, শৈশব-কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা- এসব তাদের খুব টানে। কিন্তু সবার এক সঙ্গে সময়-সুযোগ হয় না।

তবে সেই শৈশবের সময়কে তাদের কাছে টেনে নিয়ে এসেছিল ‘আমরা কাঁঠালতলী ইউনিয়নবাসী’ নামের ফেসবুক গ্রুপ। নবান্ন উৎসব উপলক্ষে সোমবার (১৬ নভেম্বর) দিনব্যাপী গ্রামীণ বিলুপ্তপ্রায় টোফাটুফি’র (চড়ুইভাতি) আয়োজন করে মৌলভীবাজারের বড়লেখার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের ‘আমরা কাঁঠালতলী ইউনিয়নবাসী’ ফেসবুক গ্রুপের উদ্যমী তরুণ-যুবকরা। আর এ অয়োজনকে ঘিরে শৈশবের আনন্দ পেতে নাগরিক ব্যস্ততার পাট চুকিয়ে সকলে ছুটে আসেন। 

দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের রুকনপুর এলাকার সবুজ অরণ্যঘেরা এক টিলায় অনুষ্ঠিত হয় চড়ুইভাতি। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় অনুষ্ঠান, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এখানে আসা সকলেই দিনভর নানা অনুষ্ঠানিকতায় ফিরে যান শৈশবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকেই লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়। অনেকদিন পর পুরোনা বন্ধুদের কাছে পেয়ে আপ্লুত হন কেউ কেউ। কেউ আবার প্রিয় মানুষদের সঙ্গে ছবি তুলে রাখেন স্মৃতি ধরে রাখতে। সবুজ অরণ্যঘেরা টিলা ও পাশের লেকে ছবি তুলেন অনেকে। বড়দের সঙ্গে আসে শিশুরাও। ঘুরে ঘুরে তাদের বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেওয়া হয়। কিভাবে আগের শৈশব ছিল এগুলো আলাপ করেন বড়রা। রান্নার আয়োজনে সকলে সহযোগিতা করেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। দুপুরে শুরু হয় খাবার পর্ব। এরপর আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন সবাই। কেউ গান গেয়েছেন, কেউ কৌতুক বলেছেন আর কেউ করেছেন আবৃত্তি। দিনব্যাপী নানা আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপন হয় চড়ুইভাতি। 

আয়োজকরা জানান, প্রথমে ‘আমরা কাঁঠালতলী ইউনিয়নবাসী’ ফেসবুক গ্রুপের এডমিন শিক্ষক আবু ইউসুফ মো. সাহিদ এ উদ্যোগ নেন। তিনি গ্রুপে একটি পোস্ট দেন। আর তাতেই সাড়া মেলে। এরপর গ্রুপের ৭৬ জন সদস্যের কাছ থেকে ১৫০ টাকা করে তোলা হয়। এরপর সবাই বসে দিনক্ষণ ঠিক করেন। শৈশবের আনন্দ উপভোগ করা ও বিলুপ্তপ্রায় গ্রামীণ ঐতিহ্যকে জাগিয়ে তুলতেই এ উদ্যোগ।

গ্রুপের এডমিন শিক্ষক আবু ইউসুফ মো. সাহিদ বলেন, ‘পহেলা অগ্রহায়নে আমাদের আয়োজন। পহেলা অগ্রহায়নে আমরা শৈশব উৎসব পালন করতাম। সারাদেশে এটা নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। আমাদের সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে ভোলাভুলি বলা হয়। আর ভোলাভুলি উৎসবের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে একটা ছিল টোফাটুফি (চড়ুইভাতি) উৎসব। মূলত এ উৎসব গ্রামীণ এলাকা থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই জিনিসটা অনুভব করে বড় পরিসরে সকলকে নিয়ে এ আয়োজন করেছি আমরা। এখানে গরিব অনেক পথশিশুকে খাওয়ানো হয়েছে। এই রেওয়াজটা যেন ভবিষ্যতে থাকে। এটা গ্রামীণ একটা ঐতিহ্য। বিলুপ্ত উৎসবকে জাগিয়ে তুলতে এই আয়োজন।’

আয়োজকদের মধ্যে মুজিবুল হক খোকন, শাহরিয়ার জামান খালেদ, আমজাদ হোসেন ও শিক্ষক ফারুক আহমদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ‘ছোটবেলা ভোলাভুলিতে অনেক আনন্দ-ফুর্তি করতাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ঘরে নতুন ধান উঠলে পিঠা উৎসব হতো। এখন গ্রামের কোথাও পিঠা খাওয়ার উৎসব হয় না। টোফাটুফি (চড়ুইভাতি) খাওয়া হয় না। এটা অনেকে এখন জানেই না। একটা সময় বিভিন্ন বাড়িতে চালের গুড়ি ভাঙার শব্দ শোনা যেত। অন্যরকম আনন্দ লাগত এ শব্দ শুনে। আজ এসব বিলুপ্ত। টোফাটুফির মাধ্যমে মিলনমেলা হয়। এতে ভাতৃত্ববোধের সৃষ্টি হয়। একে অন্যের প্রতি আন্তরিকতা বাড়ে, শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে। এখন ভার্চুয়াল লাইফে পাশে একজন বসা থাকলেও আমরা আর কথা বলি না। মোবাইলেই আমাদের সব আসক্তি। অথচ গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনুষ্ঠান নিয়মিত হলে পরস্পর পরস্পরকে জানতে পারব। শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে। আন্তরিকতা বাড়বে।’

চড়ুইভাতির অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনাম উদ্দিন, ব্যাংক কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম, গ্রুপের এডমিন শিক্ষক আবু ইউসুফ মো. সাহিদ, তরুণ সমাজসেবক জবরুল ইসলাম, মুজিবুল হক খোকন, জাগরণ সমাজকল্যাণ যুব সংঘের সভাপতি শাহরিয়ার জামান খালেদ, শিক্ষক দোলোয়ার হোসেন ইমন প্রমুখ। 

 

এজে/আরআর-০৮