সোমবার মণিপুরিদের মহারাসলীলা, উৎসবমুখর কমলগঞ্জ

সজীব দেবরায়, কমলগঞ্জ


নভেম্বর ২৯, ২০২০
০৮:০৯ অপরাহ্ন


আপডেট : নভেম্বর ২৯, ২০২০
০৮:০৯ অপরাহ্ন



সোমবার মণিপুরিদের মহারাসলীলা, উৎসবমুখর কমলগঞ্জ

মহারাসলীলাকে সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের মহড়ায় ব্যস্ত কমলগঞ্জের মণিপুরি সম্প্রদায়ের শিল্পীরা।

বাড়ির উঠানে ছেলে-মেয়েরা নাচছে। চলছে নাচের প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষক দেখিয়ে দিচ্ছেন নাচের ভঙ্গিসমূহ। কোনো জায়গায় চলছে রাসনৃত্যের মহড়া, কোনো জায়গায় রাখালনৃত্যের। এগুলো এখন শেষ সময়ের প্রস্তুতি। চলছে নৃত্যকে নিখুঁত করার, ঘষামাজা করার শেষ পর্যায়।

'দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ' বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মণিপুরি সম্প্রদায়ের অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরি সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব মহারাসলীলা আগামীকাল সোমবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মণিপুরি অধ্যুষিত গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় এখন রাস উৎসবের রং ফুটছে। মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে রং চড়ানোর কাজ। হাওয়ায় এখন নীরব সুর বাজছে- রাস আসছে, রাস আসছে।

এই রাস উৎসবের শুরু বলতে গেলে বিজয়া দশমীর পরের পূর্ণিমায়, যে পূর্ণিমা জগত আলো করে আসে। সেই পূর্ণিমা থেকেই সরবে-নীরবে শুরু হয়ে যায় রাসের প্রস্তুতি। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতির কারণে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব এবার সীমিত পরিসরে করা হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই আয়োজন সফল করতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মণিপুরি পাড়ায় চলছে চূড়ান্ত মহড়া ও আনুসাঙ্গিক প্রস্তুতি।

এ বছর কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়া মণ্ডপে পূর্ণ হবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের ১৭৮তম রাস উৎসব। মাধবপুরের রাসমেলার আয়োজক হচ্ছে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘ। ৩০ নভেম্বর দুপুরে উৎসবস্থল মাধবপুরের শিববাজার উন্মুক্ত মঞ্চ প্রাঙ্গণে হবে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য। রাতে জোড়া মণ্ডপে রাসের মূল প্রাণ মহারাসলীলা। রাতভর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপখ্যানের সে রাসলীলা উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসেন হাজারো নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষজন। তুমুল হৈ চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রী কৃষ্ণ ও তার সখী রাধার লীলাকে ঘিরে এই একটি দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জনজীবনে।

অন্যদিকে, ১৯৮৬ সাল থেকে কমলগঞ্জের আদমপুরে মণিপুরি মৈতৈ সম্প্রদায় আয়োজন করছে পৃথক রাসমেলার। আদমপুরে জোড়া মণ্ডপ ও মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে পাশাপাশি দু'টি স্থানে হবে রাস উৎসব। এখানেও থাকবে যথারীতি রাখাল নৃত্য ও রাসলীলা। তবে মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া ও মণিপুরি মৈতৈ সম্প্রদায় আলাদা স্থানে আয়োজন করলেও উৎসবের অন্তঃস্রোত, রসের কথা, আনন্দ, প্রার্থনা সবই এক। উৎসবের ভেতরের কথা হচ্ছে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সত্য সুন্দর মানবপ্রেম।

আয়োজকরা জানিয়েছেন, রাস উৎসবকে সফল করতে প্রায় মাসখানেক ধরে ৬টি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। এর মধ্যে তিনটিতে চলছে রাসনৃত্য ও তিনটিতে চলে রাখালনৃত্যের মহড়া। মাধবপুরে তিনটি জোড়া মণ্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি মণ্ডপে আছেন একজন করে পুরোহিত। সেই পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধানমতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষককে সহযোগিতা করতে একজন সহকারী প্রশিক্ষক আছেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের বাছাই করেন। এরপর সামাজিক বিধানমতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। গোপীবেশী এই শিল্পীদের বয়স ১৬ থেকে ২২ বছর। শুধুমাত্র রাধার বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর। নৃত্যের প্রতিটি দলে ন্যুনতম ১২ জন অংশ নিয়ে থাকেন। একইভাবে রাখাল নৃত্যেরও প্রতিটি দলে ২০ থেকে ২২ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালক অংশ নিয়ে থাকে।

মাধবপুর ও আদমপুরে রাসমেলার আয়োজকরা জানিয়েছেন, মহারাসলীলাল মূল উপস্থাপনা শুরু হবে দুপুর থেকে ‘গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য’ দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রীশ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ। এই রাসনৃত্য ভোর (ব্রাহ্ম মুহূর্ত) পর্যন্ত চলবে। রাসনৃত্যে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের মধুর লীলা কথা, গান ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা।

মণিপুরি মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ বলেন, 'স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। এখন পুরো এলাকায় উৎসবের আমেজ। নতুন কাপড়-চোপড় কেনা হয়েছে। আমাদের কাছে হেমন্তকাল মানেই রাসপূর্ণিমা, রাস উৎসব।'

আদমপুর মহারাসলীলা উদযাপন কমিটির অন্যতম নেতা ইবুংহাল সিংহ শ্যামল বলেন, 'আমাদের সকল আয়োজন এখন শেষপর্যায়ে। উৎসব সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হবে।'

কমলগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক ও কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান বলেন, 'আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার জন্য দুই জায়গাতেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানের নিরাপত্তায় পুলিশ তিন স্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিশি মেনে সীমিত পরিসরে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে মণিপুরি রাসলীলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। লোকসমাগম সীমিত করা হবে।'

প্রসঙ্গত, রাসলীলায় মণিপুরি নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালে সিলেট নগরের মাছিমপুরে মণিপুরি মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাসনৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্যশিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় একমাস আগে থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মণিপুরি সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরীদের রাসলীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেওয়ার ধুম পড়ে যায়। এক্ষেত্রে রাসধারী ও রাসলীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাসলীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

 

এসডি/আরআর-১১