কুলাউড়ায় বনাঞ্চল দখল, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

জিয়াউল হক জিয়া, কুলাউড়া


ডিসেম্বর ০২, ২০২০
০৮:১৭ অপরাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ০২, ২০২০
০৮:১৭ অপরাহ্ন



কুলাউড়ায় বনাঞ্চল দখল, হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে খাসিয়ারা পান চাষের নামে নির্বিচারে উজাড় করছে সংরক্ষিত বন। এতে একদিকে হুমকির মুখে পড়েছে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সংরক্ষিত এই বন রক্ষা করতে গিয়ে একাধিকবার হামলার শিকার হতে হয়েছে বন বিভাগের কর্মীদের। আর এ ব্যাপারে উদাসীন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

কর্মধা ইউনিয়নের নলডরী বনবিট সূত্র জানায়, নলডরী বিটের অধীনে ৪টি মৌজায় প্রায় ২৪৬৮.৫৪ একর সংরক্ষিত বনভূমি ছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে খাসিয়ারা ১৯৩৭.১২ একর জায়গা জরবদখল করে নিয়েছে। এই জায়গা দখল করে পান চাষের নামে গাছের ডালপালা উজাড় করায় বন বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বাকি বাঁশমহালে থাকা ৫৩১.৪২ একর জায়গাটুকুও দখল করার পাঁয়তারা চলছে। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, বন বিভাগের জায়গা অবৈধভাবে জবরদখল করে খাসিয়ার স্থাপন করেছে কয়েকটি পান পুঞ্জি। একেকটি পান পুঞ্জিতে ৩০/৩৫টি পরিবার, আবার কোনো কোনো পুঞ্জিতে ৫০/৬০টি পরিবার গৃহনির্মাণ করে জীবনযাপন করছে। তাদেরকে কোনো সরকারি খাজনা, ট্যাক্স কিছুই দিতে হচ্ছে না। তাদের নিজস্ব নিয়মেই চলছে পুঞ্জির সবকিছু। খাসিয়ারা শত শত একর জায়গায় পান চাষ করে তা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, দেশের কোনো ব্যাংকে তারা টাকা সঞ্চয় করে না। পান বিক্রি বাবদ উপার্জিত লাখ লাখ টাকা পাঠানো হয় ভারতে। ভারতে খাসিয়াদের জমি, বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

অভিযোগ আছে, পান চাষের মাধ্যমে খাসিয়ারা নষ্ট করছে বনের সৌন্দর্য্য। একসময় পাহাড়ে বেশ কয়েকটি বাঁশমহাল ছিল। বাঁশমহাল ইজারা দিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেত। কিন্তু বাঁশমহালে পান না হওয়ায় সেই বাঁশমহালগুলো কেটে তাদের দখলে নিয়ে গেছে খাসিয়ারা। পান গাছে যাতে ছায়া না পড়ে, সেজন্য শতবছরের পুরোনো গাছের মাথাসহ ডালপালা কেটে ফেলা হয়েছে। বিষ দিয়ে ঘাস ও লতা-পাতা কেটে ফেলা হয়। ফলে কমে গেছে বনাঞ্চলে হরিণ, বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আনাগোনা। পাহাড় উজাড় করে পান চাষ ও বসতি স্থাপন এবং বন্যপ্রাণী শিকার করে খেয়ে ফেলার কারণে বর্তমানে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে।

জানা যায়, গত ১৬ নভেম্বর নলডরী বনবিটের অধীনে লবনছড়া বাঁশমহালে ২৫-৩০ জন খাসিয়া মিলে ৩৫ একর বাঁশ কাটার খবর পেয়ে বন বিভাগ অভিযান চালায়। অভিযান টের পেয়ে অন্য খাসিয়ারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও নুনছড়া পানপুঞ্জির করডর খাসিয়ার ছেলে স্টেপ খাসিয়াকে আটক করতে সক্ষম হয় বন বিভাগ। এরপর ২১ নভেম্বর শ্রীমঙ্গল রেঞ্জের এসিএফ জি এম আবু বক্কর সিদ্দিক ও মুরইছড়া বন বিট কর্মকর্তা (নলডরী বিট কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) অর্জুন কান্তি দস্তিদারের নেতৃত্বে বনকর্মীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান। ওইসময় তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে সঙ্গে নেন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বন বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত দুই সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের। বন বিভাগের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় খাসিয়ারা। তাদের সহযোগিতা করেন পুঞ্জির কয়েকজন বাঙালি চৌকিদার। খাসিয়াদের হামলায় আহত হন নলডরী বন বিভাগের কর্মী আকরাম হোসেন, সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী আমির আলী, জিয়াসহ আরও ৫ জন। পরে তাদের উদ্ধার করে কুলাউড়া হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওইদিনই বিট অফিসার অর্জুন কান্তি দস্তিদার বন বিভাগের কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে খাসিয়ারা পান কাটার অভিযোগ এনে স্থানীয় বন বিভাগের উপকারভোগীদের বিরুদ্ধে কুলাউড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে। 

এ প্রসঙ্গে বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার বলেন, 'সংরিক্ষত বনাঞ্চলের পুরোটাই বাঁশ ও গাছপালায় ভরপুর ছিল। কিন্তু খাসিয়ারা পুরো বনকেই উজাড় করে ফেলেছে। খাসিয়াদের প্রধান শত্রু বাঁশ। তারা চায় না পাহাড়ে বাঁশ থাকুক। তাই বাঁশ কেটে উজাড় করছে। গাছ থাকলে সেই গাছের ছায়ায় পান না হওয়ায় তারা গাছের মাথা ও ডাল কেটে দেয়। ১-২ বছর পর পর গাছের মাথা ও ডাল কেটে দেওয়া হয়। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুঞ্জিতে যেন কেউ স্থায়ীভাবে স্থাপনা তৈরি না করতে পারে সেজন্য রড, সিমেন্ট কিংবা বালু তুলতে তাদের নিষেধ করা হয়েছে।'

বন বিভাগের উপকারভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'উপকারভোগীরা তাদের বনায়ন দেখাশোনা করবে। সামাজিক বনায়নের বিধিমালায় আছে সাধারণ জনগণ সংরক্ষিত বনাঞ্চল রক্ষা করবে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু খাসিয়ারা চায় না আমাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণ থাকুক। তাই তারা উপকারভোগী ও সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। ওইদিন আমরা এক সঙ্গে গিয়েছিলাম। কেউই তাদের বনায়নের কোনো ক্ষতি করেনি। খাসিয়াদের মূল উদ্দেশ্য হলো তারা যদি জনগণকে মামলা দিয়ে হয়রানি করে তাহলে মামলার ভয়ে জনগণ আমাদের সঙ্গে থাকবে না। আর জনবল কম থাকলে আমরা তাদের সঙ্গে পারব না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি এই বিটে যোগদান করার পরই দেশের সম্পদ পাহাড় রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সবসময়ই পাহাড় কাটার প্রতিবাদ করেছি। বিভিন্ন সময় খাসিয়াদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তাই আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য খাসিয়ারা চেষ্টা করছে।' 

এ ব্যাপারে কুলাউড়ার প্রবীণ বাম নেতা প্রসান্ত দেব ছানা বলেন, 'পাহাড় যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে মানুষ ও সভ্যতা শেষ হয়ে যাবে। সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে পাহাড় রক্ষা করতে হবে। তবে খাসিয়াদের সরিয়ে দেওয়া যাবে না। পাহাড় রক্ষায় দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।'

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিনয় ভূষন রায় জানান, লবনছড়ার ঘটনায় খাসিয়া এবং বন বিভাগ পরস্পরকে দায়ী করে থানায় মামলা দায়ের করেছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

 

জেএইচ/আরআর-১০