বিশ বছর ধরে ভাতাবঞ্চিত শহীদ মন্তাজের পরিবার

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
০৯:০০ অপরাহ্ন


আপডেট : ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
০৯:০০ অপরাহ্ন



বিশ বছর ধরে ভাতাবঞ্চিত শহীদ মন্তাজের পরিবার

পিতার সমাধির পাশে শহীদ মো. মন্তাজ মিয়ার সন্তান মো. আজিদ আলী।

প্রায় ২০ বছর ধরে ভাতাবঞ্চিত সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জের উত্তর কামলাবাজ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মো. মন্তাজ মিয়ার পরিবার। এখন অভাব-অনটনে দিন কাটছে শহীদ পরিবারটির। সব ঠিকঠাক থাকার পরও গেজেটে প্রকাশিত ভুল নামের কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ভাতা পাওয়ার ব্যাপারটি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর বিপক্ষে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছিলেন মন্তাজ মিয়া।

৪৮ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনিও শুয়ে আছেন সুনামগঞ্জের ডলুরা শহীদ সমাধিস্থলে। দেশকে স্বাধীন করতে অকাতরে জীবনদান করেও মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা জুটছে না তাঁর পরিবারের। শহীদ পিতার মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা নিশ্চিতে দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বলে জানিয়েছেন শহীদ সন্তান মো. আজিদ আলী।

ডলুরা শহীদ সমাধিস্থল সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সমাধিস্থলের প্রবেশদ্বার অর্থাৎ প্রধান ফটকের বামদিকে সবার উপরে ১ নম্বরে শহীদ মন্তাজ মিয়ার নাম লিপিবদ্ধ আছে। ভেতরে দণ্ডায়মান ৪৮ জন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকাস্তম্ভেও ১ নম্বরে আছে মো. মন্তাজ মিয়ার নাম। এছাড়া সমাধিস্থলের চারপাশে বেষ্টিত প্রবেশমুখের সোজা বিপরীত অংশের বামদিকের প্রথম সমাধিটিই শহীদ মন্তাজ মিয়ার। নামফলকে লেখা আছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মন্তাজ মিয়া (আনসার), পিতা মৃত আব্দুল গনি, সাং-কামলাবাজ, জামালগঞ্জ, সুনামগঞ্জ। কিন্তু সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হওয়া মন্তাজ মিয়ার পরিবারকে ভুল নামের কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। সর্বশেষ শহীদ স্ত্রী রুকিয়া খাতুন ১৯৯৯ সালের ৩১ আগস্ট ১ হাজার ৬০০ টাকা ভাতা উত্তোলন করলেও পরবর্তীতে তিনি মারা যাওয়ার পর আর কোনো ভাতা পাননি বলে জানিয়েছেন এই বীর শহীদের সন্তানেরা।

এ সংক্রান্ত কাগজপত্র ও তথ্যাদি ঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যার ২৮৫২ নম্বর ক্রমিকে উত্তর কামলাবাজ গ্রামের মৃত আব্দুল গনির ছেলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. মন্তাজ মিয়ার পরিবর্তে শহীদ মমতাজ মিয়া নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁর নাম উপজেলার খসড়া তালিকার ৫ নম্বর ক্রমিকে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ০৫০২০৭০১৪৯ এর পাশাপাশি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ডাটাবেইজ অনলাইন আইডি ১৫৩ নম্বর ক্রমিকের ০৭০৪১৩৮৯১৭ সহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালিকার ৩ নম্বর ক্রমিকে উল্লেখ আছে। গেজেট সংশোধন সংক্রান্ত আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা ৪৮.০০.০০০০.০০৪.৪০.২৫৯.১৮.৫৬৫৫ নম্বর স্মারকে সরেজমিনে তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়। তার জবাবে জামালগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সরজমিনে তদন্ত করে চলতি বছরের ১৯ আগস্ট ০৫.৬০.৯০৫০.০০১.৩১.০৯০.২০-৭৩৫ (২) স্মারকে শহীদ মন্তাজ মিয়ার নাম গেজেটে সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।

জানা গেছে, ডলুরা শহীদ সমাধিস্থল থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরের সীমান্তবর্তী এলাকা নলুয়ার বেড়িগাঁওয়ে সম্মুখযুদ্ধে মো. মন্তাজ মিয়া শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই বালাট সাব-সেক্টরের কমান্ডার মেজর (অবঃ) আব্দুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন মন্তাজ মিয়া। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে সহযোদ্ধারা শহীদ যোদ্ধাদের মরদেহ ডলুরায় এনে সমাহিত করেন।

মন্তাজ মিয়ার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুস সোবহান বলেন, ‘আমরা এক সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আমাদের দলে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হওয়াদের মাঝে মন্তাজ মিয়াই প্রথম। তাঁর পরিবারের ভাতা না পাওয়াটা আসলেই বেদনাদায়ক। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই শহীদ পরিবারটি যাতে দ্রুত ভাতা পায় সেই দাবি জানাই।’

শহীদ মন্তাজ মিয়ার নিকটাত্মীয় প্রতিবেশী মো. ময়না মিয়া (৭৬) বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাড়িতে কাউকে কিছু না বলেই মন্তাজ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। ডলুরায় তাঁর কবরও আছে। একসময় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার স্ত্রী রুকিয়া খাতুন বেশ কয়েকবার ভাতা উত্তোলন করেছেন। পরে তিনি মারা যাওয়ায় প্রায় ২০ বছর ধরে ভাতা পাচ্ছে না তাঁদের ছেলে-মেয়েরা। বর্তমানে ভাতা পেতে অনেক জায়গায় দৌড়াদৌড়িও করছে তারা। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তার পরিবারের ভাতা না পাওয়াটা খুবই দুঃখজনক।’

জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্রতিবেশী সোহেল আহমেদ বাচ্চু বলেন, ‘মন্তাজ মিয়া একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। দেশের তরে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েও তাঁর পরিবার আজ অবহেলিত, বঞ্চিত। স্থানে স্থানে ঘুরে তারা এখন ক্লান্ত। এই পরিবারটি অতিকষ্টে দিনাতিপাত করছে, এটা আমাদের জন্য লজ্জার। ভুল নামের সমস্যাটা দূর করে দ্রুত ভাতাপ্রাপ্তি হোক আমরা এটাই চাই।’

শহীদ সন্তান মো. আজিদ আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তার পিতা দেশের জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু নামের ভুলে প্রায় ২০ বছর যাবৎ ভাতা পাচ্ছে না তাঁর পরিবার। শহীদ পিতার নামে রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা পেতে দীর্ঘদিন ধরে এখানে-সেখানে দৌড়ঝাঁপ করে তারা আর পারছেন না। এখানে-সেখানে ঘুরে অনেক টাকাও খরচ হয়েছে। কর্তৃপক্ষের একটা সামান্য ভুলের বড় মাশুল গুণতে হচ্ছে তাদের। কবে শহীদ মমতাজ পাল্টে নাম শহীদ মন্তাজ হবে আর ভাতা জুটবে কপালে, তাও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। নাম সংশোধন করে দ্রুত ভাতাপ্রাপ্তির আর্জি জানিয়েছেন তিনি।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। সেখানে যদি গেজেট সংশোধন করে দেয়, তাহলে সমস্যাটা হয়তো সমাধান হয়ে যাবে।’

 

বিআর/আরআর-১০