জামালগঞ্জে হালি হাওরের ‘বিষফোঁড়া’ মামুদপুরের ভাঙা

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জানুয়ারি ০৩, ২০২১
১১:০০ অপরাহ্ন


আপডেট : জানুয়ারি ০৩, ২০২১
১১:০০ অপরাহ্ন



জামালগঞ্জে হালি হাওরের ‘বিষফোঁড়া’ মামুদপুরের ভাঙা

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে হাওরখেকো চক্রের ছলচাতুরী এখনও অব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খেয়ালিপনায় বাঁধের বস্তি অংশ কেটে প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজছে হাওরপাড়ের কুচক্রী মহল। উপজেলার বৃহৎ হাওরখ্যাত হালি হাওরের বেশক'টি অংশ কেটে বড় বড় ক্লোজারে পরিণত করেছে তারা। এর মধ্যে বেহেলী ইউনিয়নের হালি হাওরের মামুদপুর অংশের বৃহৎ ভাঙাটি ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়ে হাওরপাড়ের মানুষের দুঃখ বাড়িয়ে দিয়েছে। মামুদপুর গ্রামবাসীর বাধা উপেক্ষা করে একই গ্রামের ইউপি সদস্য মো. মসিউর রহমান গত বোরো মৌসুম পরবর্তী সময়ে বাঁধ কেটে নিজের ফায়দা হাসিলে সচেষ্ট বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।

অপরদিকে, অবৈধ মাছ শিকারীরা বদরপুর ও হাওড়িয়া আলীপুরের মাঝখানে ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন বাঁধ এবং শনি হাওরের ঝালোখালি ক্লোজার থেকে একটু দূরের বস্তি বাঁধ কেটে বৃহৎ ক্লোজারের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া হাওড়িয়া আলীপুরের পার্শ্ববর্তী ভাঙাসহ মহালিয়া হাওরের দুই স্থানে বড় গর্ত করে বৃহৎ বরাদ্দ হাতিয়ে সরকারি অর্থ অপচয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছে ওই সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী। হালি হাওরে সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে এমন শঙ্কিত বাস্তবতা চোখে পড়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরব ভূমিকায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাওরপাড়ের অগণিত কৃষক।

বেহেলী ইউনিয়নের মামুদপুর ভাঙায় গিয়ে দেখা যায়, পূর্বের সরু একটি ভাঙনকে পরিকল্পিতভাবে বিশাল খালে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমানে ভাঙনকৃত দুইপাড়ের দূরত্ব হবে প্রায় শত গজ। ধান রোপণের শুকনো মৌসুমেও ওই ভাঙাটিতে থই থই করছে পানি। স্থানীয়রা কৃষিকাজের সুবিধার্থে মামুদপুরের পানিপূর্ণ ভাঙনে লম্বা বাঁশের সাঁকো দিয়েছেন। ভাঙন তীরবর্তী ৪-৫টি কৃষক পরিবারের বাড়ি-ঘর ভাঙনের কবলে পড়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অপর প্রান্তের ভাঙন ছুয়েছে কবরস্থান পর্যন্ত। ভাঙনের ফলে টিলার মতো বড় বড় চর জেগে চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে বেশকিছু জমি। এতে ক্ষতি হয়েছে অনেক কৃষকের। এছাড়া হাওরখেকো চক্র স্থানে স্থানে বড় বড় ক্লোজারের সৃষ্টি করে পুরো হাওরকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন মামুদপুরসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক বাধা প্রদান করেও মামুদপুরের ভাঙন ঠেকাতে পারেননি তারা। গ্রামবাসীর পক্ষে অনেকে বাধা দিতে গেলে মসিউর মেম্বার ইউএনও'র অজুহাত দেখিয়ে অনেকটা জোর করেই ভেঙে দিয়েছে এ বাঁধ। পরবর্তী বছরে বড় বরাদ্দ প্রাপ্তির আশায় বাঁধটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ইউএনও বিশ্বজিত দেব একদিন এসে ভাঙনটি দেখে গেলেও চেয়ারম্যান অসীম তালুকদার একদিনের জন্যও এসে দেখেননি এ ভাঙন কতটুকু খারাপ অবস্থায় আছে। মামুদপুরের ভাঙন ছাড়া এই হাওরের চারপাশে আরও বড় বড় ভাঙন পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

মামুদপুর গ্রামের প্রবীণ মো. মুজিবুর রহমান বলেন, 'এই ভাঙনের লাগি ইউপি মেম্বার সম্পূর্ণভাবে দায়ী। হে মানুষ লইয়া বাঁধটা কুপাইয়া ভাঙছে। বড় পিআইসি পাওয়ার লাগি হে এই কামডা করছে। এতে কয়েক হাল জমিনের ক্ষতি হইছে। বাঁধের কাছের কয়েকটা বাড়িও ভাঙছে। আর বাঁধের ব্যাপারে ঝুঁকিটা তো সারাজীবনই থাকব।'

একই গ্রামের আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, 'এইডা মেম্বার নিজে কামলা ধইরা ভাঙাইছে। এই ভাঙনে আমরা কয়জনের বাড়ি-ঘর লইয়া গেছে, আপনেরে তো দেখাইছি। চার-পাঁচ হাল জমিনও নষ্ট হইছে। খালডাও অনেক গভীর হইছে। এখন ভরাট করতে অনেক মাটি লাগব। আমার মনে হয় প্রজেক্ট পাইবার লাগি হেরা এইডা করছে। না হইলে তো এইডা ভাঙার দরকার নাই।'

বেহেলী ইউনিয়নের হাওর বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক আমিনুল হক মনি এক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, 'মামুদপুরের ভাঙনটি বর্তমানে বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের বাধা ডিঙিয়ে যারা এই জঘন্যতম কাজটি করেছে তারা পুরো হাওরবাসীর সঙ্গে শত্রুতা করেছে। এটা করার আগে অন্তত কৃষকের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমি এর প্রতিবাদ জানাই।'

তবে গ্রামবাসীর অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি সদস্য মো. মসিউর রহমান বলেন, 'মামুদপুরের ভাঙার ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। গ্রামবাসীই চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটি ভেঙেছে। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। তবে চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে ভাঙতে বলেছিলেন, আমি না করে দিয়েছি।'

আর বেহেলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অসীম তালুকদার বলেন, 'যখন ধান কাটা শেষ তখন হাওরে পানি প্রবেশের জন্য বাঁধ কেটে দেওয়া হয়। উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্দেশ মোতাবেক মেম্বারকে বলা হয়েছে এটা ভাঙার জন্য। বাঁধ কাটার এখতিয়ার তো আমাদের নেই। আমরা এটা করতে যাব কেন?'

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের জামালগঞ্জ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, 'উপজেলার প্রতিটা হাওরেই কুচক্রীমহলের সহায়তায় মাছ আহরণের ছল করে অবৈধ মাছ শিকারীরা নতুন-পুরাতন বাঁধ কেটে বড় ক্লোজার সৃষ্টি করে যাচ্ছে। এর প্রবণতা হালির হাওরেই বেশি। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।'

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) উপজেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. রেজাউল কবীর বলেন, 'এটা অফিসিয়ালি কাটা হয়েছে। উপজেলা কমিটির সভায় ইউএনও মহোদয়ের নির্দেশে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রতিবছরই যেহেতু এটা কাটা হয়, সেহেতু বিভিন্ন পয়েন্টে পানি বেড়ে যাওয়ায় এটা করা হয়েছে। আর অন্যান্য ভাঙন যেগুলো সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো রাতের আঁধারে কে বা কারা করেছে সে তথ্য আসলে আমাদের কাছে নেই। সেগুলোর মেজারমেন্ট করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, 'মামুদপুরের ভাঙা আমি দেখে এসেছি। এটা সার্ভে করা হয়েছে। এবার ঠিক করা হবে।'

 

বিআর/আরআর-১২