প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাননি গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধা মখলিছ আলী

মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হেলালী, দোয়ারাবাজার


ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১
১১:০৭ অপরাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২১
১১:০৭ অপরাহ্ন



প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাননি গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধা মখলিছ আলী
জীবন কাটছে ভিক্ষা করে

১৯৭১ সালে দেশমাতৃকার টানে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মখলিছ আলী (৭৫)। তিনি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ডুলপশি (নয়াগাঁও) গ্রামের বাসিন্দা। একাত্তরে জীবন বাজি রেখে সেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টরের হারিণাপাটি, টেংরাটিলা, নরসিংপুর, বড়োগল্লা, গোবিন্দগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অস্ত্র হাতে সক্রিয় যুদ্ধ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে জয় নিয়ে ফিরলেও জীবনযুদ্ধের ময়দানে হেরে যেতে বসেছেন তিনি। এক জটিলতায় পড়ে পাচ্ছেন না মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি। গৃহহীন হয়েও এবার পাননি প্রধানমন্ত্রীর উপহার জমিসহ ঘর। ছেলে-মেয়েরাও না দেখায় ভিক্ষা করে স্ত্রীকে নিয়ে সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশায় কাটছে তাঁর জীবন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মখলিছ আলী দেশকে হানাদারমুক্ত করতে একাত্তরে যুদ্ধকালীন কমান্ডার খোরশেদ আলমের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। একই ইউনিয়নের সহযোদ্ধা কাটাখালী গ্রামের আকিল আলী ও মান্নারগাঁও গ্রামের রবি দাস, টেংরাটিলা গ্রামের আজিম উদ্দিনের সঙ্গে ভারতের ইকোওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে ২৫ নম্বর ব্যাচে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সক্রিয় যুদ্ধ করলেও তিনি আজ সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সহযোদ্ধারা ভাতাপ্রাপ্ত হলেও মখলিছ আলী কাগজপত্রের জটিলতায় এখনও অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন। 

১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে পাকবাহিনীকে সারেন্ডার করানোর পূর্ব পর্যন্ত সক্রিয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এই যুদ্ধবীর। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর বাড়ি ফিরে শুরু হয় তাঁর জীবনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে লড়তে লড়তে ক্লান্ত-শ্রান্ত এই রণবীর এখন অসহায়। তিনি জানান, ১৯৮৮ সালের বন্যায় বসতঘরের সঙ্গে পানিতে ভেসে গেছে মুক্তিযুদ্ধের সকল কাগজপত্র। বহু বছর ধরে সরকারি দপ্তর ও সহযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কাগজপত্রের জটিলতার অবসান করতে পারছেন না তিনি।

দেশ স্বাধীনের পর কিছুদিন যুদ্ধকালীন ৫ নম্বর সেক্টরের সেলা (বাঁশতলা) সাব-সেক্টর কমান্ডার হেলালউদ্দিন প্রদত্ত 'হেলাল ভাতা' পেলেও সরকারি ভাতা থেকে বঞ্চিত এই বীরসেনা। নেই নিজের কোনো ভিটেমাটি। দীর্ঘ ৩ দশক যাবত স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন অন্যের বাড়িতে। বর্তমানে দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ডুলপশি (নয়াগাঁও) গ্রামের তাজউদ্দীনের বাড়িতে তার আশ্রয়ে পরিত্যক্ত একচালা ছোট একটি কুড়েঘরে স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। জীবন চালান ভিক্ষা করে, কখনও কখনও গ্রাম-পঞ্চায়েতের সহযোগিতা নিয়ে। সংসার জীবনে ১ মেয়ে ও ৩ ছেলের জনক হলেও ভিটেমাটি না থাকায় ছেলেরা বাবা-মাকে ফেলে চলে গেছে অন্যত্র। ছেলেরাও শ্রমিকের কাজ করেন। তাদেরও নেই কোনো ভিটেমাটি। অন্যের বাড়িতে থেকে শ্রমিকের কাজ করে চলে তাদের জীবন-জীবিকা।

এখন মখলিছ আলী বয়সের ভারে একেবারেই ন্যুব্জ। পাশে নেই কেউ। মজুর হিসেবেও কাজ করতে পারেন না। তাই সংসারের চাকা ঘোরাতে কাঁধে নিয়েছেন ভিক্ষার ঝুলি। ভিক্ষা করেই ৭৫ বছরের মানুষটি এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। চোখের পানি ঝরানো ছাড়া মখলিছ আলীর এখন আর কিছুই করার নেই। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৯ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। পাল্টে গেছে এই বাংলার চিত্র। কিন্তু পাল্টায়নি মখলিছ আলীর ভাগ্য। মখলিছ আলী একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। জীবিত সহযোদ্ধারাও তা অকপটে স্বীকার করেন। যাচাই-বাছাইেয় বহুবার চাক্ষুষ সাক্ষীও দিয়েছেন তারা। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, কাগজপত্রের জটিলতায় বঞ্চিত রয়ে গেলেন তিনি।

ভাতাবঞ্চিত এই অসহায় মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পর থেকে বার বার আবেদন করেও এ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেননি তিনি। তাঁরই সহযোদ্ধা দূর্গাপুর গ্রামের ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা কালা মিয়া বলেন, 'মখলিছ আলী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমরা এক সঙ্গে ট্রেনিং করেছি, একই সঙ্গে দেশ স্বাধীন করা অবধি যুদ্ধ করেছি। আমাদের কাগজপত্র সংরক্ষণ করা থাকলেও তাঁর কাগজপত্রের জটিলতায় তিনি আজ বঞ্চিত।' 

একই কথা বলেছেন তাঁর আরেক সহযোদ্ধা কাটাখালী গ্রামের আকিল আলী। তিনি বলেন, 'আমরা এক সঙ্গেই যুদ্ধ করে দেশকে হানাদারমুক্ত করেছি। অথচ কাগজপত্রের কারণে মখলিছ আলী আজ বঞ্চিত। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আজ মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি।'

আলাপকালে মখলিছ আলী বলেন, '১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেও এখন পর্যন্ত মেলেনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ। পাইনি কোনো ভাতা বা সরকারি সাহায্য। তাই ভিক্ষার ঝুলি আমার একমাত্র সম্বল। যখন শরীরে শক্তি ছিল, তখন কাজ করে সংসার চালাতাম। এখন আর শরীরে শক্তি নেই, তাই কেউ কাজেও নেয় না। সংসার চালাতেই ভিক্ষার ঝুলি নিয়েছি। ভিটেমাটি নেই, থাকি অন্যের বাড়ি।'

তিনি জানান, তাঁর ভিটেমাটি নেই, থাকেন অন্যের আশ্রয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার থেকেও তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। পাননি ভিটেমাটি ও গৃহহীন হিসেবে একখানা পাকা ঘর।

প্রধানমন্ত্রীর উপহার থেকে কেন গৃহহীন মখলিছ আলী বঞ্চিত- এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য অজিত চন্দ্র প্রজিৎ সিলেট মিররকে বলেন, 'মখলিছ আলী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও গৃহহীন। তিনি থাকেন অন্যের বাড়িতে। কিন্তু এই এলাকায় বাড়ি করার মতো সরকারি খাস ভূমি না থাকায় অসহায় এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার পাকা ঘর বানিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবুও তাঁর বিষয়ে আমি ইউএনও ম্যাডামকে অবহিত করেছি।'

এ বিষয়ে জানতে দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া সুলতানার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধার তালিকা দেওয়া হলে খাস ভূমি না পেলেও অন্যত্র আমরা গৃহহীন ওই মুক্তিযোদ্ধাকে ঘর বানিয়ে দেব।' 

 

এইচএইচ/আরআর-০১