সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
০৩:১৮ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
০৩:১৮ পূর্বাহ্ন
প্রতারণার মাধ্যমে অকৃতদার মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তান সেজে ভাতা উত্তোলনের ঘটনায় ফেঁসে গেছেন জামায়াত নেতা আব্দুল লতিফ। দীর্ঘদিনের তদন্ত শেষে জামায়াত নেতাও ভুয়া সন্তান সাজার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে বার বার নোটিশ দেওয়ার পরও টাকা জমা না দেওয়ায় এবং প্রতারণা করায় তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে ভাতা আদায়ে জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে মামলা করার মৌখিক নির্দেশ দেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে জামায়াত নেতা আব্দুল লতিফের প্রতারণার বিষয়টি অবগত হয়ে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছিলেন সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সদস্যসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিক ভাতা বন্ধের আদেশ দিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক সরকারি টাকা আদায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। তদন্তে আব্দুল লতিফ বীর মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তান হিসেবে প্রমাণিত হন। তিনি নিজেও তদন্ত কমিটির কাছে তা স্বীকার করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের সরদারপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন মারা যান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিয়ে করেননি। ফলে তার কোনো সন্তানও নেই। একই গ্রামের আফতর আলীর ছেলে ইউনিয়ন জামায়াতের কোষাধ্যক্ষ মো. আব্দুল লতিফ এই সুযোগে একটি চক্রকে ম্যানেজ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিনের ভুয়া ছেলে সেজে ভাতার জন্য আবেদন করেন। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিনের ছেলে পরিচয়ে পৌর জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি ও জেলা আইনজীবী সমিতির এক সদস্যের মাধ্যমে ভুয়া সন্তানের বিষয়টি সত্যায়ন করেন। এর আগে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার শান্তি কমিটির নেতা ইউপি চেয়ারম্যান আঞ্জব আলীর কাছ থেকে জন্ম নিবন্ধন সংগ্রহ করেছিলেন মো. আব্দুল লতিফ। তবে তদন্ত কমিটিকে সব ঘটনা খুলে বলে ভুয়া সন্তান সাজার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন আব্দুল লতিফ।
২০২০ সনের ২২ নভেম্বর তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত জবানবন্দি দিয়ে আব্দুল লতিফ তার বাবার নাম আফতর আলী উল্লেখ করেন। লিখিত জবানবন্দিতে জামায়াত নেতা আব্দুল লতিফ উল্লেখ করেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা কমাণ্ডের ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরামর্শ নিয়ে তিনি ভুয়া ছেলে সেজে ভাতার জন্য আবেদন করেন। তবে আবেদনের আগে ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল হককে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক নেতা টেলিফোন করে আব্দুল লতিফকে উত্তরাধিকারী সনদ প্রদানের অনুরোধ করলে তিনি উত্তরাধিকারী সনদ প্রদান করেন। এরপর আব্দুল লতিফ ভাতাপ্রাপ্তির জন্য আবেদন করলে ২০১৭ সালের ৪ জুন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বিতরণ সংক্রান্ত উপজেলা কমিটির সভায় মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাতার জন্য প্রতিস্থাপিত হন। এ পর্যন্ত আব্দুল লতিফ ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা ভাতা উত্তোলন করেন।
লিখিত জবানবন্দিতে আব্দুল লতিফ উল্লেখ করেন, ভাতাপ্রাপ্তির যাবতীয় কাগজপত্র জমাদানের সময় মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডের এক নেতার কাছে দুই দফায় তিনি ১০ হাজার টাকা ঘুষ দেন। কিছুদিন পর দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা নেতা তাকে সঙ্গে নিয়ে সোনালী ব্যাংকে গিয়ে চেকের মাধ্যমে ৭০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। তবে উত্তোলনকৃত এই টাকা থেকে ৪৫ হাজার টাকা নিয়ে নেন ওই দুইজন। এরপর প্রতিবারই ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের পর তিনভাগের দুই ভাগ তার কাছ থেকে রেখে দিতেন তারা। টানা দুই বছর তিনি ভাতা উত্তোলন করেন। এভাবেই তিনি তার নিজ হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার লিখিত জবানবন্দিতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দেন।
গতবছরের ২০ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জামায়াত নেতা আব্দুল লতিফ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নন বলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির তদন্তের প্রেক্ষিতে প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসক বরাবরে প্রেরণ করেন। ২০২০ সনের ৮ অক্টোবর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি আব্দুল লতিফের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৬ অক্টোবর অন্য অভিযুক্তদের জবানবন্দি গ্রহণ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্ত কমিটির কাছে অভিযুক্ত তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল হক ওয়ারিশান সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি স্বীকার করেন। তবে ইউপি সদস্য স্বপ্না বেগম দাবি করেন, তার সরলতার সুযোগে চতুর আব্দুল লতিফ ওয়ারিশান সনদে স্বাক্ষর নিয়েছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদনে ওয়ারিশান সনদে চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রমাণিত বলে মন্তব্য করে তদন্ত কমিটি। আব্দুল লতিফের ভাতাপ্রাপ্তিতে সহযোগিতা ও অবৈধ সুবিধাগ্রহণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতবছরের ৬ অক্টোবর অভিযুক্ত তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা কোনো অনৈতিক সুবিধা নেননি বলে তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে জানান। একইদিন ইউপি চেয়ারম্যান নূরুল হক ও ইউপি সদস্য স্বপ্না বেগমও আত্মপক্ষ সমর্থন করে তদন্ত কমিটিকে লিখিত জবাব দেন। জেরার জবাবে তারা স্বাক্ষর প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করেন।
এদিকে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমাদানের পর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. আরিফুল ইসলাম গতবছরের ২১ ডিসেম্বর ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে আব্দুল লতিফের কাছ থেকে সমুদয় ভাতা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমাদানের জন্য নির্দেশসহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
এ ঘটনায় অভিযোগকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর বলেন, 'জামায়াত নেতা স্বীকার করেছে সে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নয়। তদন্তেও বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। প্রশাসন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা আনন্দিত। তবে এই অপকর্মে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই, যাতে আগামীতে কেউ মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে এভাবে ব্যবসা করতে না পারে।'
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'বীর মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তান সেজে প্রতারণা করে ভাতা উত্তোলনের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ভাতা আদায়ে আব্দুল লতিফের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা গ্রহণের জন্য আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি।'
এসএস/আরআর-০৮