বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
১১:৩৮ অপরাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১
১১:৩৮ অপরাহ্ন
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজে মন্থর গতি পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রতিটি বাঁধ ও ক্লোজারে ঢিমেতালে চলছে হাওর সুরক্ষায় বাঁধের কাজ। কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় মাস পর কাজে হাত দেওয়া হলেও ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারগুলোতে কেবলমাত্র মাটি ফেলা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ৩-৪টি বাঁধে মাটি ফেলার কাজ প্রায় ৩০-৪০ ভাগে পৌঁছালেও কোনো কোনো বাঁধে এখনও পড়েনি এক ছটাক মাটি। দুই-একটি বাঁধ ছাড়া কোনো বাঁধেই পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট পিআইসি সভাপতিকে। কয়েকটি বাঁধে পিআইসি সদস্য সচিবকে পাওয়া গেলেও অন্যসব বাঁধে সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া মাটি ফেলা ছাড়া কোনো বাঁধেই কনপেকশনসহ আনুষাঙ্গিক কাজে হাত দেওয়া হয়নি। হালি, শনি ও মহালিয়া হাওরের ২৬টি পিআইসির প্রায় ২০টি বাঁধ ঘুরে এমন আশঙ্কাজনক বাস্তবতা চোখে পড়েছে। এতে করে যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ার ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন হাওরপাড়ের কৃষক ও হাওর সচেতন মানুষেরা।
গত সোমবার দিনব্যাপী হাওররক্ষা বাঁধ পরিদর্শন করে দেখা যায়, হালি হাওরের বদরপুর সংলগ্ন ৪১ নম্বর পিআইসির বাঁধে নামমাত্র মাটি ফেলা শুরু হয়েছে। এর পরবর্তী ৪০ নম্বর পিআইসির ঘনিয়ার বিলের ভাঙায় কাজ চলমান থাকলেও এর বিপরীতপাড়স্থ শনি হাওরের (১৯ নম্বর পিআইসি) নান্টুখালী ক্লোজারে তড়িঘড়ি হালকা মাটি ফেলে দ্রুত কাজের ধারাবাহিকতার জানান দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবে এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার। ৩৯ নম্বর পিআইসির হাওড়িয়া আলীপুরের শেষ মাথার ক্লোজারটি ভরাট করা সম্ভব হলেও অবশিষ্ট সকল কাজ এখনও বাকি আছে। হাওড়িয়া আলীপুরের অপরপাড়ের শনি হাওরের (২০ নম্বর পিআইসি) সবচেয়ে বিপজ্জনক ক্লোজার হিসেবে পরিচিত লালুর গোয়ালা প্রায় অক্ষত থাকলেও এর শেষভাগে ছোটখাটো যে ভাঙন আছে, তাতে এখনও মাটি ফেলাই শেষ হয়নি। এর কাজ স্বল্প সময়ে শেষ হওয়ার কোনো আলামতও চোখে পড়েনি।
অপরদিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হালি হাওরের সবচেয়ে বড় ক্লোজার (৩৮ নম্বর পিআইসি) মামুদপুরের ভাঙার কাজও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। হাওরের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ এই ক্লোজারসহ এ বাঁধের সম্পূর্ণ কাজ ২০ ভাগও এগোয়নি। বাঁধে পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট পিআইসির সভাপতিকে। এ বাঁধে নির্দেশিকা বোর্ড দেখতে না পেয়ে দায়িত্বরত একজনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি অন্যত্র পড়ে থাকা বোর্ড দেখিয়ে দেন। বাঁধরক্ষা কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই ব্যক্তি কয়েকদিনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা জানালেও বাঁধের সন্নিকটে বসে থাকা মামুদপুর গ্রামের জনৈক ব্যক্তি জানিয়েছেন, আগামী ২০-২৫ দিনেও এর কাজ শেষ হবে না।
এছাড়া ৩৭ নম্বর পিআইসির কাজে এখনও হাত দেওয়া হয়নি। অপরপাড়ের মহালিয়া হাওরের ৪টি (২১, ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর) পিআইসির মধ্যে ২টিতে কাজ শুরু হয়েছে। বাকি ২টি বাঁধে কাজ এখনও শুরু হয়নি। মদনাকান্দি থেকে শুরু হওয়া ৩৬ নম্বর পিআইসির কাজের অগ্রগতি কিছুটা তুষ্টিদায়ক হলেও এর পরবর্তী আছানপুর ছোঁয়া ৩৫ নম্বর পিআইসির বাঁধে একটি ক্লোজার থাকা সত্ত্বেও সেখানে পড়েনি একমুঠো মাটি। অন্যদিকে আছানপুর থেকে সুন্দরপুরের কালীবাড়ি বাঁধ অর্থাৎ ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর পিআইসির কাজ প্রায় ৩০ ভাগ হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। হাওররক্ষা বাঁধের কাজের এমন মন্থর গতি দেখে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন স্থানীয় কৃষকরা। তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জোর তাগিদ দিয়ে জানিয়েছেন, গেল ৩ বছর বন্যা হয়নি। এ বছর আগাম বন্যার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যথাসময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে বিপদ হতে পারে।
হাওররক্ষা বাঁধ থেকে ফেরা উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি শাহানা আল আজাদ বলেন, 'হালি হাওরের দুটি পিআইসিতে মোটামুটি ভালো কাজ হয়েছে। আর বাকি সব পিআইসির কাজে তেমন অগ্রগতি নেই। অনেক কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে।'
একই দিনে বাঁধে যাওয়া সাচনা বাজার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল হক আফিন্দী বলেন, 'আমরা হালি হাওরের ৬-৭টি বাঁধ ঘুরে দেখেছি। এসব বাঁধে কাজ কেবল শুরু হয়েছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছে না। সর্বসাকুল্যে ১০ ভাগ কাজ হয়েছে। কাজ যতটুকু হয়েছে তাতে দুর্বল কাজই মনে হচ্ছে।'
সদ্য হাওর থেকে ফেরা উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন পুরকায়স্থ জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত হাওরে যে কাজ হয়েছে তা গতবছরের তুলনায় বিপরীত। গেল বছরে এই সময়ে প্রায় ২০ ভাগ কাজ বাকি ছিল, কিন্তু এ বছর মাত্র ২০ ভাগ কাজ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হবে কি না এ নিয়ে কৃষকসহ সচেতন মহল হতাশায় ভুগছেন। কারণ চলতি বছরে আগাম বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অল্প সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, 'ওয়ার্কঅর্ডার বিলম্বসহ অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বাঁধে মেশিন কম। যার কারণে কাজ দেরিতে হচ্ছে। এছাড়া বাঁধে গিয়ে সংশ্লিষ্ট পিআইসিদেরও পাওয়া যাচ্ছে না। তারা এ কাজটাকে তেমন পাত্তা দিতে চাইছে না। দ্রুত কাজ সম্পন্নে পিআইসিদের বাঁধমুখী করতে প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে।'
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং কাবিটা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি বিশ্বজিত দেব বলেন, 'আমাদের শর্তটা এরকম- যখন যে নির্দেশনা দেওয়া হবে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে মাটির কাজ শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। এ সময়ের মধ্যে যারা মাটির কাজ শেষ করতে পারবে না, তাদের বিরুদ্ধে আমরা অ্যাকশনে যাব। আর ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাকি যে কাজ থাকবে, তা যথাসম্ভব দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হবে।'
বিআর/আরআর-০১