ফসলরক্ষা বাঁধ : সরকারি টাকায় শুভঙ্করের ফাঁকি!

সোহেল তালুকদার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ


ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১
০২:১৪ পূর্বাহ্ন


আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১
০২:১৪ পূর্বাহ্ন



ফসলরক্ষা বাঁধ : সরকারি টাকায় শুভঙ্করের ফাঁকি!
বিপুল অর্থ বরাদ্দে হয়েছে নামমাত্র কাজ, এখনও গঠন হয়নি ১০টি পিআইসি

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের কাউয়াজুরী হাওরে এভাবেই অলস পড়ে আছে মাটি কাটার যন্ত্র।

সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হয়েছিল গত ১৫ ডিসেম্বর। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে মোট ৪৯টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কমিটি (পিআইসি) গঠন করে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দেখার হাওর, সাংহাইর হাওর, কাচির ভাঙ্গা হাওর, খাই হাওর, জামখোলার হাওর ও কাউয়াজুরী হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধের সংস্কার কাজ শুরু হলেও এখনও অনেক পিআইসি তাদের প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারেনি।

অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা হঠাৎ করে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার কাউয়াজুরী হাওরে নতুন করে আরও ১০টি পিআইসি অনুমোদন করিয়েছেন। এ নিয়ে এই হাওরে ১৫টি পিআইসি অনুমোদন পেল। যেখানে চলতি বছরের প্রথমদিকে এই হাওরে ৫টি পিআইসির অনুকূলে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ৮৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা, সেখানে ফেব্রুয়ারির ১০-১১ তারিখে একই জায়গায় একই কাজে আরও ১০টি পিআইসি অনুমোদন করে ১৫টি পিআইসিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু এখনও নতুন ১০টি পিআইসি গঠন করা হয়নি।

হাওরবাসী বলছেন, এই হাওরে গত ২ বছর ধরে নামমাত্র কাজ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এই হাওরে কেউ যান না। খাতা-কলমে কাজ থাকলেও এই হাওরে গেল ২ বছর চোখে পড়ার মতো কোনো কাজ হয়নি। তারা জানিয়েছেন, গেল ২ বছর এই হাওরে বৈশাখ মাস পর্যন্ত মাটি কাটার মেশিন (এসকেভেটর) রাখা হয়, যাতে করে মনিটরিং কমিটি বা অন্য কেউ এলে দূর থেকে দেখতে পান এই হাওরে কাজ হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজই হয় না এই হাওরে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, এই হাওরে গেল ২ বছর ধরে কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এই হাওরে ৫টি প্রকল্প নিলেও পরে ডিজাইন পরিবর্তন করে ৫টি পিআইসি ভেঙে এখন ১৫টি করা হয়েছে। কাজের দৈর্ঘ্য আগের মতোই রয়েছে, শুধু কাজের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বরাদ্দ বেড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের কাউয়াজুরী হাওরে মোট ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জরিপ ও প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদস্যদের নিয়ে শুনানির মাধ্যমে ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয় এবং যথারীতি সরকারিভাবে গেজেট ও সরকারি পোর্টালে তথ্য উন্মুক্ত করা হয়। এ ৫টি প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ৮৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। কিন্তু নতুন ১০টি প্রকল্পের কোনো তথ্য এখনও সরকারি ওয়েব পোর্টালে দেওয়া হয়নি। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিও গঠন করা হয়নি।

আরও জানা যায়, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ৪৯টি প্রকল্পে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও কাউয়াজুরী হাওরে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। তবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রথম আর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ২য় বারের মতো এখানে ৭টি প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩১ হাজার ২০৪ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রথম দফায় এই হাওরে ৫টি প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয় ৮৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। কিন্তু এই অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি মাসের ১০-১১ তারিখে নতুন করে আরও ১০টি মিলিয়ে মোট ১৫টি প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কাজের মোট দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার ৩০০ মিটার।

কিন্তু দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দায়িত্বে থাকা সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুব আলম কোনো এক অদৃশ্য কারণে পিআইসিদের কাজ বুঝিয়ে না দিয়ে প্রাক্কলন ও কার্যাদেশের ত্রুটি দেখিয়ে সময়ক্ষেপন করতে থাকেন। অবশেষে গত ১০ ফেব্রুয়ারি কাউয়াজুরী হাওরে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুব আলম ৫টি প্রকল্পকে ভেঙে মোট ১৫টি প্রকল্পে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। এ যেন সরকারি টাকায় শুভঙ্করের ফাঁকি! পিআইসিদের মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাতের মচ্ছবে নেমেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাওরে মৌখলা গ্রামের পাশে একটি মাটি কাটার মেশিন (এক্সকেভেটর) পড়ে আছে। এখানে সামান্য কাজ করা হয়েছে। মৌখলা গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, ২-১ দিন হয়েছে এখানে মেশিনটি এসেছে। আসার পরেই এটি নষ্ট হয়ে যায়। গ্রামের পশ্চিমে আরও একটি মাটি কাটার মেশিন একেবারে ধীরগতিতে কাজ করছে। সবমিলিয়ে এই হাওরে এখন পর্যন্ত ১০০-১৫০ মিটার কাজ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ হাওরে আর কোথাও কোনো কাজের সন্ধান মিলেনি।

অমূল্য দাশ, অতুল দাশসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, 'ইতা খতা খইয়া কোনো লাভ অইতো নায়। ইখানো খালি মিশিন দেখানি অয়, কাম অয় না।' এভাবেই স্থানীয় ভাষায় তারা জানান, গত ২ বছর ধরে এই হাওরে নামমাত্র কাজ হয়েছে। পাউবো'র কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এখানে চলছে হরিলুটের মহোৎসব। গেল বছর এই হাওরে বৈশাখ মাসের শেষ সময় পর্যন্ত ৩টি মাটি কাটার মেশিন ফেলে রাখা হয় বলেও জানান তারা। কৃষকদের ধান কাটা শেষ হওয়ার পরে এই মেশিনগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী গেল ২ বছরও তেমন কোনো কাজ হয়নি এই হাওরে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কাউয়াজুরি হাওরে চলতি বছর মোট আবাদী জমির পরিমাণ ১৮ হাজার ৭৫ হেক্টর এবং হাইব্রিড ও উফসি জাতীয় বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৫শ মেট্রিক টন ধান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, কৃষি অফিসের কোনো কর্মকর্তাকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয় না। কিন্তু আমরা বোরো ধান আবাদ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাঠে-ঘাটে কাজ করি। আমরা জানি কোন হাওরে কত হেক্টর ফসলি জমি আছে এবং কতটুকু আবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ফসলের তুলনায় দ্বিগুণ, তিনগুণ বরাদ্দ দিয়ে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাহবুব আলম জানান, মন্ত্রণালয় থেকে আরও ১০টি প্রকল্প এই হাওরে পাস হয়ে এসেছে। জেলা কমিটি অনুমোদন দিলেই আমরা কাজ শুরু করব। তবে এখনও কোনো পিআইসি গঠন করা হয়নি।

তিনি জানান, অল্প সময়ে পিআইসি কমিটি কাজ সম্পন্ন করতে না পারলে এই ১৫টি প্রকল্প ঠিকাদারকে দিয়ে বাস্তবায়ন করব। ১৫টি প্রকল্পে মোট দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার ৩০০ মিটার। মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

মাহবুব আলম বলেন, 'গত অর্থবছরের কথা আমি বলতে পারব না। আমি এই উপজেলায় নতুন এসেছি। আগে এই হাওরে কী হয়েছে না হয়েছে সেটি আমার জানা নেই।'

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান জানান, যে ৫টি প্রকল্প ছিল এই ৫টির মধ্যেই এখন ১৫টি করা হয়েছে। এখনও কোনো ক্লোজার নেই, শুধু টানা কাজ। আগের উচ্চতা থেকে এখন একটু বেশি দেওয়া হয়েছে, তাই বরাদ্দ বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে পিআইসিরা কাজ সম্পন্ন করতে পারবেন।

 

এসটি/আরআর-০৬