আমীর হোসাইন, শাল্লা
ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১
১২:২১ পূর্বাহ্ন
আপডেট : ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১
১২:২১ পূর্বাহ্ন
সুনামগঞ্জের দুর্গম জনপদ শাল্লা উপজেলা এখন যেন দুর্নীতির আখড়া। শাল্লায় ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে ঘুষ, দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-প্রকৌশলী (এসও) শমসের আলী মন্টুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তাকে শাল্লা থেকে বদলি করা হয়। এতে দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন স্থানীয় কৃষকরা। কিন্ত তা আর হলো না। দুর্নীতিতে শমসের আলী মন্টুকে ছাড়িয়ে গেছেন বর্তমান এসও আবদুল কাইয়ূম। তার দুর্নীতির কারণে অতিষ্ট শাল্লাবাসী।
কাইয়ূম বাঁধের কাজে নিয়োজিত এক একটি পিআইসি থেকে এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা অগ্রিম ঘুষ নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া ভ্যাটের কথা বলে প্রতিটি বিলে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। যারা টাকা বেশি দিয়েছেন, তারা অল্প জায়গায়ও বরাদ্দ বেশি পেয়েছেন। অনেক অক্ষত বাঁধ আছে যেসব বাঁধে মাটি ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই। সেসব বাঁধেও প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে।
২৯ নম্বর বাঁধের পিআইসি সভাপতি তপন দাশ বলেন, 'আমরা বাঁধের কাজ বন্ধ রেখেছি। কাজ আর করব না, সরকারের কাছে হস্তান্তর (সারেন্ডার) করব।'
হস্তান্তর করার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, 'আমরা কি জমি বিক্রি করে শ্রমিকের বেতন দেব? এসওকে এক লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে পিআইসি এনেছি। ৮ লাখ টাকার ড্রাম ট্রাকে মাটি কাটিয়েছি। এখন আবার এসও সাহেবকে প্রতি বিলে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ টাকা দিয়ে আসতে হয়। তা না হলে তৃতীয় ও চতুর্থ বিল কাজের ত্রুটি দেখিয়ে আটকে দেবে। তাহলে আমরা কি করব? টাকা বেশি দেওয়ার কারণে ৩০ নম্বর বাঁধের দৈর্ঘ্য কাগজে-কলমে ৪১০ মিটার দেখালেও বাস্তবে ৩০০ মিটারের বেশি হবে না।'
৩০ নম্বর বাঁধের সদস্য সচিব বৃহস্পতি দাস বলেন, 'আমরা অনেক টাকা অগ্রিম দিয়ে পিআইসি এনেছি। তার পরেও অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ টাকা দিতে হয়। তাই আমরা সরকারের কাছে প্রকল্প হস্তান্তরের কথা ভাবছি।'
মৌরাপুর গ্রামের জহুরলাল দাস বলেন, 'অফিস ১০ শতাংশ ভ্যাট রাখে। বের হওয়ার পর এসও সাহেব রাখে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। আর টাকা ছাড়া কিছু হয় না। কিন্ত এই টাকার কথা কাউকে বলাও যাবে না।'
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই ঘুষ প্রদানের কথা স্বীকার করেছেন, আবার অনেকেই মুখ খুলতে নারাজ। শ্রীহাইল গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও বিষ্ণুপুর গ্রামের রতিন্দ্র দাস বলেন, '১২৯, ১৩০ ও ১৩২ নম্বর বাঁধগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত। এ বছর এগুলোতে বাঁধের কোনো প্রয়োজন নেই।'
বিষ্ণুপুর গ্রামের ভোলাই বৈষ্ণব বলেন, '৩ নম্বর এবং ৪ নম্বর বাঁধ দুটি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। যেখানে আমাদের এত বড় গ্রাম আছে, সেখানে বাঁধ দুটির কোনো প্রয়োজন নেই। এছাড়া আরও অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অক্ষত বাঁধে কাজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।'
এদিকে এসব অপকর্ম ঢাকার জন্য সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে নেওয়া হয় বিভিন্ন কৌশল। গোপন সূত্রে জানা যায়, এসও'র এ অপকর্মের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় তিন সাংবাদিককে উপহার দেওয়া হয়েছে ১৩ নম্বর পিআইসি'র কাজ। নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজ পাবেন বাঁধ এলাকার কৃষক। অথচ সেখানে ওই তিন সাংবাদিকের এক শতক জমিও নেই। আরেক সাংবাদিককে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ড লেখার দায়িত্ব। প্রতিটি সাইনবোর্ডের মূল্য ২ হাজার টাকা। তবে স্থানীয় পংকজ দাসের পক্ষ থেকে একই সাইনবোর্ড ১ হাজার ১শ টাকা মূল্যে দেওয়ার জন্য লিফলেট দেওয়া হয়। এতে সাইনবোর্ডের কাজ পাওয়া সাংবাদিক ক্ষিপ্ত হয়ে এসওর যোগসাজসে লিফলেটগুলো ছিঁড়ে ফেলেন এবং এসও কাইয়ূম পংকজ দাসকে সাইনবোর্ড বিক্রি না করার পরামর্শ দেন।
আরেকটি সূত্রে জানা যায়, আরেক সাংবাদিককে দিয়ে প্রতিটি বাঁধ থেকে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা আনানো হয়। শনাক্তকারী হিসেবে তার সঙ্গে দেওয়া হয় এসও'র গাড়িচালক শাহিনূরের ভাই কাউসারকে। এই সাংবাদিকরা গতবছর বাঁধের কাজের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লেখালেখি করলেও এ বছর এখন পর্যন্ত তাদের কোনো প্রতিবেদন চোখে পড়েনি।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-প্রকৌশলী আবদুল কাইয়ূমের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপ করতে চাইলে ঘুষ নেওয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কল কেটে দেন। পরে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কল রিসিভ করেননি তিনি।
এএইচ/আরআর-০৩