শামস শামীম, সুনামগঞ্জ
মার্চ ২৬, ২০২১
১১:৩৫ অপরাহ্ন
আপডেট : মার্চ ২৬, ২০২১
১১:৩৫ অপরাহ্ন
কামারগাঁওয়ের মুক্তিমাঝি মজর আলী ও তার স্ত্রী। দু'জনেরই মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে বিশেষ অবদান।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার কথিত চোরের গ্রাম কামারগাঁও। চারদিকে হাওর। দুর্গম গ্রাম। হেমন্তে এবড়োখেবড়ো আল বেয়ে গ্রামে পৌঁছাতে হয়। কোনো রাস্তাঘাট নেই। বর্ষায় নৌকাই একমাত্র বাহন। দুর্গম ও পশ্চাদপদ এই গ্রামবাসীর বেশিরভাগই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। দুর্গম হাওরাঞ্চলের রাস্তাঘাট তাদের নখদর্পনে থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চালিয়ে পথ দেখিয়েছেন গ্রামের ৩০-৪০ জন যুবক। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানের জন্য দান করেছিলেন ৫টি নৌকা। গ্রামের নারীরা রেঁধে খাইয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করায় হাওরাঞ্চলের কুখ্যাত রাজাকার আজমিরীগঞ্জের আলী রেজার নির্দেশে ৪ ডিসেম্বর ভোরে তিনদিক দিয়ে গ্রামে অতর্কিত হামলা চালায় রাজাকারবাহিনী। দূর থেকে গুলিবর্ষণ করায় গ্রামবাসী দ্রুত বেরিয়ে পড়েন একদিকে। পালাতে গিয়ে শহীদ হন ৫ জন। আহত হন অনেকে। পরে গ্রামে ঢুকে সবগুলো ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাছাই করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ২০ জন নারীকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে কামারগাঁওবাসীর এই আত্মত্যাগের ইতিহাস আজও চাপা পড়ে আছে। তাদের মহিমান্বিত ত্যাগের কথা জানেন না এলাকাবাসী।
গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিরোধ যুদ্ধের মাসখানেক পরেই টেকেরঘাটে চলে যান এই অঞ্চলের তরুণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় সংগঠকরা ওই গ্রামটির তরুণদের যুদ্ধে যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এলাকার হাফিজ উদ্দিন, মন্নান চৌধুরী, সুকুমার দাসসহ মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকরা কামারগাঁও গ্রামে আসেন। গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানালে গ্রামের সব নারী-পুরুষ দেশের পক্ষে কাজ করার অঙ্গিকার করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য গ্রামের লেছু মিয়া সরদার, লেবু মিয়া, তাজু মিয়া, আলমাছ মিয়াসহ ৫ জন ৫টি নৌকা দান করেন। বিশেষ একটি পেশার প্রতি আকৃষ্ট থাকায় কামারগাঁওবাসী সহজেই হাওরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ভালো চিনতেন। তাই হাওরের দুর্গম ও অপরিচিত পথে মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী নৌকায় কান্ডারি ও সহায়তাকারী হিসেবে গ্রামের যুবকদের মধ্যে দায়িত্ব দেওয়া হয় কালু মিয়া, মজর উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, আজমান আলী, জয়নাল মিয়া, মুসলিম উদ্দিন, জুনাব আলী, শহিদ মিয়া, কেরামত আলী, জলা মিয়া, জালাল মিয়া, নূর মিয়া, এলমদর মিয়াসহ গ্রামের অন্তত ৩০-৪০ জন যুবককে। বিভিন্ন সময়ে হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোণার বীর মুক্তিযোদ্ধারাও এই গ্রামে আশ্রয় নিতেন। তখন গ্রামের নারীরা তাদের রান্নাবান্না করে খাওয়াতেন। সেই চিহ্ন এখনও আছে।
গ্রামবাসী জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের জন্য মজর মিয়ার ঘরের সামনে মাটি খুঁড়ে সাতটি চুলা তৈরি করা হয়। মজর আলীর স্ত্রী ললিতা বেগম রান্নাবান্নার কাজে নেতৃত্ব দেন। তাকে সহযোগিতা করেন আফজল বিবি, মাস্টরের মা, মন বিবিসহ আরও ৪-৫ জন নারী। প্রায় দিনই দুর্গম গ্রামটিকে নিরাপদ ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন। এই রাঁধুনি নারীদের মধ্যে জীবিত আছেন মাত্র দুই নারী।
গ্রামবাসী জানান, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সকালে রাজাকাররা প্রতিশোধ নিতে হামলে পড়ে গ্রামে। তিনদিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ করে তারা। নিরীহ নারী-পুরুষরা পশ্চিম-উত্তরের পথ ধরে পালানোর চেষ্টা করেন। রাজাকারবাহিনীর গুলিতে শহিদ হন গ্রামের মজর আলীর কিশোর ছেলে আলী হোসেন, ইন্তাজ আলী, মিয়াফর আলী, মধু মিয়া ও মোজাফফরের মা। গ্রাম বাছাই করে নূরজান বিবি, ফরজান বিবি, সজিবা বেগম, মন বিবি, কুলসুম বিবি, আফজল বিবি, শহীদের মাসহ অন্তত ২০ জন নারীকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা। এই নারীদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। কয়েকজন এখনও জীবিত আছেন। শেষে গ্রামে ঢুকে পেট্টল ঢেলে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
গ্রামবাসী জানিয়েছেন, রাজাকাররা আতঙ্কিত হয়ে পরবর্তীতে কামারগাঁও গ্রামবাসী রাজাকারদের ওপর চরম প্রতিশোধ নিতে পারে এই ভয়ে বিজয়ের প্রাক্কালে এই মরণকামড় দিয়ে গ্রামের নিশানা মুছে দিতে চেয়েছিল রাজাকাররা।
কামারগাঁও গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার কান্ডারি কালু মিয়া (৬৫) বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমরা খরছি। আমরার বউরা মুক্তিরে রাইন্দ্যা খাবাইছে। ঘরবাড়ি জ্বালাইছে আমরার। বালবাচ্চারে গুলি কইরা মারছে আলী রেজা রাজাকার। আমরার বউ-ঝিরে ধইরা লইয়া গ্যাছে। এখন আমরারে কেউ চিনে না। মুক্তির স্বীকৃতি দেয় না। রাজাকার অইযায় মুক্তিযোদ্ধা। আমরার কেউ নাই। হকলে আমরারে ঘৃণা করে। আমরার মুক্তিযুদ্ধের কথা কয় না।’
মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়ানোর জন্য নারীদের যে টিম গঠন করা হয়েছিল তাতে নেতৃত্ব দিনে মজর আলীর স্ত্রী ললিতা বেগম। এছাড়াও আফজল বিবি, মাস্টরের মা, মন বিবিসহ অনেক নারী এই রান্নাবান্নার কাজ করতেন। প্রায় প্রতিদিনই তাদের রান্না করে খাওয়াতে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের। এ কাজে কখনও ক্লান্তিবোধ করেননি তারা। প্রায় আড়াই থেকে তিন মাস বর্ষাকালীন সময়টা গ্রামের নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেন। এই নারীদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাণ্ডারি মজর আলীর স্ত্রী ললিতা বেগম ছিলেন রান্নার প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত নারী। সারি সারি চুলা দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘কিতা কইয়াম বাজান। আমরার গেরাম আছিল মুক্তির ঘাঁটি। তারারে রাইন্দা খাবাইতাম। নাও বুঝাই দিয়া মুক্তির দল আইয়া খাইতো। রাত-দিন খাবাইতাম। আমরার কষ্ট অইতো। কিন্তু তারারে বুঝতাম দিতাম না। ছোডো ছোডো ছেলে-পুলের মুখ দেইখ্যা মায়া লাগতো।’ ললিতা বেগম বলেন, ‘বাজান আমি মুক্তির লাগি পোয়া কোয়াইলাম। আমার কুন্তা অইবনি?’
গ্রামের তরুণ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা চালিয়েছেন। মাঝে মধ্যে অস্ত্রও ধরেছেন। মা রান্না করে খাইয়েছেন। আমার এক ভাই রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হয়েছে। আমরা কোনো স্বীকৃতি পাইনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই অবদান কেউ স্বীকার করে না। স্বীকৃতির জন্য আমার বাবা আবেদন করলেও কেউ সাক্ষী না দেওয়ায় তা বাতিল হয়েছে। আমরা কিছু চাই না। একাত্তরে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাজি রেখে সহযোগিতা করেছিলাম, তার স্বীকৃতিস্বরূপ গ্রামে স্মৃতিসৌধ চাই। যেখানে শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের নাম লেখা থাকবে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি শহিদুল মিয়া বলেন, 'আমার মা ও চাচীকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রাজাকাররা। নির্যাতন করেছে। তারা মারা গেছেন। আমিও অবহেলায় জীবনযাপন করি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সহযোগিতা পাই না। আমাদের গ্রামে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, তার কোনো স্মৃতিচিহ্নও নাই। আমরা নিজেরা কিছু পাই বা না পাই, আমাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য যুদ্ধের স্মৃতিটি গ্রামে দেখতে চাই।'
১৯৯১ সালের নির্বাচনে নির্বাচনী ভোটার তালিকায় পেশা হিসেবে চোর লিখে জাতীয়ভাবে আলোচনায় আসেন কামারগাঁওবাসী। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ এ অপবাদ থেকে বাঁচতে অন্যত্র চলে গেছেন। এখন যারা বসবাস করেন তারা সবাই হতদরিদ্র। কেউ আর এই চোরের 'পেশায়' নেই। বর্তমানে গ্রামে ৩২টি খুপড়ি ঘরে ৯০টি পরিবার বসবাস করে। সরকারি-বেসরকারি সবধরনের সহায়তাবঞ্চিত রয়ে গেছে এই গ্রামবাসী। কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন নেই। মুক্তিযুদ্ধে তাদের আত্মদানস্বরূপ একটি স্মারক নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা। যাতে আগামী প্রজন্ম বুক চিতিয়ে জানান দিতে পারে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধে তারা জড়িত ছিলেন।
এসএস/আরআর-০১