বিশ্বজিত রায়, হালি হাওর থেকে ফিরে
এপ্রিল ০৯, ২০২১
১২:০৫ পূর্বাহ্ন
আপডেট : এপ্রিল ০৯, ২০২১
১২:০৫ পূর্বাহ্ন
চতুর্দিকে সবুজের ছড়াছড়ি। মাঝখানে খড়কুটো আর বাঁশের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ ঘরগুলো। চারপাশের শস্যশ্যামলা বসন সরিয়ে তার কাছ ঘেঁষলে অনুভব করা যায় সংগ্রামী জীবনের প্রাণচঞ্চল ডাক। দূর থেকে ডেরাগুলো দেখলে মনে হয় ধানী জমির বুক চিঁড়ে জেগে ওঠা কোনো গহীন চর। নয়তো গাঢ় সবুজে ঘিরে ধরা কোনো নিভৃত পল্লী। সবুজের অবারিত ঢেউয়ে নিরন্তর হাবুডুবু খাওয়া এই জীবনযাপন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ।
হরিৎ হাওরের সর্বাঙ্গীন পাহারায় সদা জাগ্রত এই অস্থায়ী ডেরায় বসে ক্লান্তি দূর করার পাশাপাশি স্বপ্ন বোনেন একফসলী জমির সোনালি কারিগর কৃষকরা। হাওরের কান্দায় ক্ষণকালের জন্য তৈরি তাঁবু আকৃতির এসব ঘরে আশ্রয় নিয়েই কর্দমাক্ত হাওরকে সবুজ আর সবুজ হাওরকে সোনালি শস্যে ভরিয়ে তুলতে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যান হাওরপাড়ের এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে হাওররক্ষা বাঁধের কাজের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে চোখে পড়ে সুবিধাবঞ্চিত কৃষকদের এমন জীবনাচরণ।
বেহেলী ইউনিয়নের হালি হাওর তীরবর্তী বদরপুর ও হাওড়িয়া আলীপুরের পার্শ্ববর্তী রাঙ্গিয়া কান্দার পতিত জমিতে অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকা এসব কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার সবাই পেশায় কৃষক। কৃষিই তাদের প্রধান পেশা। অন্তত ৫ শতাধিক কৃষক পরিবারের আশ্রয় সেখানে। তারা সবাই জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়নের উত্তর কামলাবাজ গ্রামের বাসিন্দা। বাড়ি থেকে জমির দূরত্ব বেশি হওয়ায় সময়মতো চাষাবাদ এগিয়ে নিতে তারা শুকনো মৌসুমে এখানে চলে আসেন। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই রাঙ্গিয়া কান্দায় তাদের ঘর বাঁধার প্রস্তুতি শুরু হয়। অগ্রহায়ণ মাস থেকে ফসল তোলার আগ (জ্যৈষ্ঠ মাস) পর্যন্ত প্রায় ৬-৭ মাস খরা ও ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে তারা ফসল উৎপাদন করে থাকেন। এখানকার কৃষকরা শিলা ও বজ্রবৃষ্টিসহ কালবৈশাখী ঝড় শুরু হলে অনেকটা জীবনবাজি রেখে এসব খুপড়ি ঘরে অবস্থান করেন বলে জানা গেছে।
কৃষকরা আরও জানান, তাদের স্থায়ী আবাসস্থল উত্তর কামলাবাজ গ্রামে ঘনবসতি হওয়ায় সেখানে গরু-বাছুর ও হাঁস-মুরগী পালন করা সম্ভব হয় না। তাই কৃষিকাজের পাশাপাশি গৃহপালিত পশু ও হাঁস-মুরগী পালনে এই খোলা হাওরে বসবাস করাটা লাভ ও সুবিধাজনক মনে করছেন তারা। এ কৃষকদের সবারই কমবেশি জমি আছে এই হাওরে। মূলত ফসল ঘরে তোলার স্বার্থেই প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে তারা এখানে অবস্থান করেন। কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার কথা মাথায় রেখে হাওরপাড়ের খাস জায়গায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে পারলে কৃষি কাজসহ বিস্তীর্ণ হাওরে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালন করে স্বাবলম্বী হতে পারবেন এসব অবহেলিত কৃষক- এমন দাবি জানিয়েছে কৃষক পরিবারগুলো।
ধানুয়াখালী কামলাবাজ থেকে রাঙ্গিয়ায় এসে বসবাস করা কৃষক মো. সেলিম মিয়া বলেন, 'আমরা মূলত কৃষিজীবী। কৃষিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। বাড়ি থেকে জমি দূরে হওয়ায় চাষাবাদে আমাদের মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই জমি করার স্বার্থে আমরা বছরের ৬-৭ মাস এই রাঙ্গিয়ায় ছোট ছোট ঘর বেঁধে অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করি। এখানে থেকে আমরা যে ধান ফলাই সেই ধান রাখার মতো বাড়িতেও তেমন জায়গা নেই। সরকার এখানকার খাস জায়গা নির্ধারণ করে আমাদেরকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দিলে আমাদের উপকার হতো।'
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, 'আমরাই হাওরপাড়ের প্রকৃত কৃষক। বছরের ৬-৭ মাস আমরা হাওরেই পড়ে থাকি। কিন্তু হাওররক্ষা বাঁধের কাজ আমাদের কাউকে দেওয়া হয় না। কাজ দেওয়া হয় যাদের, তারা হয় নামকাওয়াস্তে কৃষক, নয় তো হাওর থেকে দূরবর্তী গ্রামে তাদের বাড়ি। এভাবে সবকিছুতেই আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।'
আরেক কৃষক মো. জামাল মিয়া জানান, কৃষিকাজের সময় এলেই তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে চলে আসেন। একেবারে ফসল তোলা শেষ করে বাড়িতে ফেরেন। নির্জন হাওরের বুকে থাকতে গিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যে পড়তে হয় তাদেরকে। তবুও জীবিকা নির্বাহের প্রধান ক্ষেত্র কৃষিকাজের জন্যই এখানে থাকতে হয় তাদের। বৈরি প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে তারা যে ফসল উৎপাদন করেন, সেই ফসল বাড়িতে নিতে পারেন না। যাতায়াত সুবিধা না থাকায় শুধুমাত্র খোড়াকের বুঝ রেখে বাকি ধান হাওরেই বিক্রি করে দেন সবাই।
কষ্ট চেপে রাখতে না পেরে তিনি জানান, এই রাঙ্গিয়ায় পূর্বে একটি গ্রাম ছিল। তাদের পূর্বপুরুষের আশ্রয় ছিল সেখানে। কিন্তু ঢেউয়ে সবকিছু ভেঙে বিলীন করে দিয়েছে এই গ্রাম। তাই অন্যত্র চলে গেছেন সবাই। কৃষি ও কৃষকের কথা ভেবে সরকার এখানে নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে গুচ্ছগ্রামের ন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে খুবই উপকার হবে তাদের। এই দাবি এখানকার সকল কৃষকের।
উত্তর কামলাবাজ গ্রামের কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, 'হাওরের মধ্যে ছোট ঘর বেঁধে কৃষিকাজ করি আমরা। ছয় মাস এখানেই আমাদের থাকা-খাওয়া, এখানেই বাড়িঘর। এত কষ্ট করে আমরা ধান ফলাই। কিন্তু গোলায় তুলতে পারি না। অর্ধেক দামে বিক্রি করে দিতে হয়। আমাদেরকে এখানে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানাই।'
এ নিয়ে উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আক্কাছ মুরাদ বলেন, 'কোনো এক সময় এখানে বাড়িঘর ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখন এখানে কিছু নেই। সবাই অন্যত্র চলে গেলেও জমিজমার মায়া ও জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে অস্থায়ীভাবে ঘর বানিয়ে এখানে চলে আসেন কৃষকরা। কৃষকরা কষ্ট করে যে ফসল ফলান, সেই ফলন বাড়িতে নিতে না পেরে অল্প দামে বিক্রি করে দেন। যদি সরকারের তরফ থেকে এখানে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তাহলে এখানকার কৃষক পরিবারগুলো বেশ উপকৃত হবে।'
বিআর/আরআর-০১