ফের মানবতার গানে মুখর শাল্লার সেই গ্রাম

শামস শামীম, সুনামগঞ্জ


এপ্রিল ১৩, ২০২১
১২:০১ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০২১
১২:০১ পূর্বাহ্ন



ফের মানবতার গানে মুখর শাল্লার সেই গ্রাম

গত ১৭ মার্চ সাম্প্রদায়িক হামলায় তছনছ হয় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁও। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের অনুসারীরা ভাঙচুর ও লুটপাটের পাশাপাশি হতদরিদ্র দু'টি পরিবারের বাদ্যযন্ত্রও গুড়িয়ে দিয়ে যায়। পরদিন ১৮ মার্চ গ্রাম পরিদর্শনে এসে গুড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্র দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। গানের উপকরণ গুড়িয়ে দেওয়া লোকদের তিনি অমানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

হামলায় বাদ্যযন্ত্রহারা ওই গ্রামের বাসিন্দা মনমোহন দাস একজন শ্রমজীবী মানুষ। সৌখিন শিল্পীও তিনি। সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে সন্ধ্যায় পরিবারের লোকজনসহ পাড়ার লোকদের নিয়ে মনের সুখে গান করেন। নৈমিত্তিক ব্যথা, যাতনা সুরে সুরে উড়িয়ে দেন। সেদিন বাদ্যযন্ত্র হারিয়ে তিনি খুবই মর্মাহত হন। তার মতো একই পাড়ার ১০ম শ্রেণির ছাত্রী পিতা-মাতাহীন কন্যা শ্রাবন্তী দাসের বাদ্যযন্ত্রও গুড়িয়ে দিয়ে যায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা। শ্রাবন্তীর মনও ছিল বেজায় খারাপ। তাদের এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে দু'টি পরিবারকে বাদ্যযন্ত্র উপহার দিয়েছে ইস্টহ্যান্ডস নামক একটি মানবিক সংগঠন। সেই যন্ত্র পেয়ে এখন আবারও সুর তুলছেন মন মোহন দাস ও শ্রাবন্তী দাস। বেদনাভরা কণ্ঠে তারা প্রাণ খুলে গাইছেন মানুষের মিলনের গান। গত ৭ এপ্রিল তাদের হাতে এ বাদ্যযন্ত্রগুলো তুলে দেওয়া হয়।

তারা গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা প্রার্থনার ভাষায় গাইছেন লালনের 'ভবে মানবগুরু নিষ্ঠা যার/সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার', 'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের 'তুমিও মানুষ আমিও মানুষ, সকল এক মায়ের সন্তান/ এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব কেন, কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান’ ইত্যাদি গান। এছাড়া কীর্তনের বিরহের সুরেও তারা মানবতার গান গাইছেন। অসুর বিনাশের আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের গান শুনতে আসছেন পাড়ার লোকজনও।

শান্তি, সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির রোল মডেল সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী বাবু অক্ষয় কুমার দাস, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল মহাজন শাহ আবদুল করিম, রামকানাই দাস, সুহাসিনী দাসসহ অসংখ্য ব্যক্তির পদচারণায় সম্প্রীতির রসে ভেজা এই হাওর-ভাটির মাটি। কিন্তু গত ১৭ মার্চ হেফাজত নেতা মামুনুল হককে নিয়ে ফেসবুকে করা পোস্টকে কেন্দ্র করে তার হাজারও অনুসারী হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে হামলা ও লুটপাট করে এলাকার সম্প্রীতি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। গুড়িয়ে দেয় মন্দির ও মূর্তি। গরিব গ্রামবাসীর সাংসারিক উপকরণ তছনছ করার পাশাপাশি শিশুদের বইপত্র ছিঁড়ে নষ্ট করে দিয়েছিল তারা। কয়েকটি পরিবারের গানের বাদ্যযন্ত্রগুলো নষ্ট করে দিয়েছিল। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে ফের বাদ্যযন্ত্র কেনা তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন ছিল।

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুড়িয়ে দেওয়া বাদ্যযন্ত্র দেখে যুক্তরাজ্য থেকে ইস্টহ্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আ স ম মাসুম দু'টি পরিবারকে সঙ্গীতযন্ত্র কিনে দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। যন্ত্রের পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে তারা গ্রামে দু'টি নলকূপও স্থাপন করে দিয়েছেন। দু'টি পাড়ার অর্ধশত মানুষ এখন সেই নলকুপের বিশুদ্ধ পানি পান করার সুযোগ পাচ্ছেন। আর সৌখিন গায়েন মনমোহন দাস ও শ্রাবন্তী দাসের গানের জলসায় সুখ খুঁজছেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত গ্রামবাসী।

মনমোহন দাস কাজ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন। তার সন্তানরা খোল, করতালসহ অন্যান্য লোকজ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তাকে সহযোগিতা করে। কিন্তু ১৭ মার্চ হামলাকারীরা তার ঘরদোর ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি এই বাদ্যযন্ত্রগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি এই বাদ্যযন্ত্র আবার কীভাবে জোগাড় করবেন এই চিন্তায় অস্থির ছিলেন। তাকে অবাক করে দিয়ে ইস্টহ্যান্ডস হারমোনিয়াম, তবলা, খোল, করতাল উপহার দিয়েছে। এমন উপহার পেয়ে বিস্মিত তিনি। জলভরা চোখে কেবল কৃতজ্ঞতা জানালেন।

মনমোহন বলেন, 'আমি হারমোনিয়াম দিয়ে সব সময় গান গাই। আমার হারমোনিয়ামটি তারা ভেঙে দিয়েছিল। এখন নতুন হারমোনিয়াম-খোলসহ বাদ্যযন্ত্র পেয়ে আমি খুব খুশি। কোটি টাকা পেলেও আমি এমন খুশি হতাম না। এগুলো পেয়ে প্রথমদিনই পাড়ার মানুষদের জড়ো করে লালনের মানবমিলনের গান গেয়েছি। করিম মহাজনের গান গেয়েছি। আমরা পেছনের বিষাদ ভুলে যেতে চাই। সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাই।' চোখের জল মুছে তিনি বলেন, 'এই বাদ্যযন্ত্রগুলো আমরা স্মৃতিতে মমি করে রাখব।'

একই পাড়ার বাসিন্দা মৃত রন্টু দাসের মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী শ্রাবন্তী দাস। সাধ্য নেই তার একটি হারমোনিয়াম কেনার। মা অনেক কষ্টে একটি খোল কিনে দিয়েছিলেন। সেই খোলেই মগ্ন থাকত সে। তার খোলটিও অসুররা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল। তাকেও একটি উন্নত খোল উপহার দিয়েছে ইস্টহ্যান্ডস। উপহার পেয়ে বিস্মিত শ্রাবন্তীও।

শ্রাবন্তী বলে, 'আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে খোলটি কিনে দিয়েছিলেন। সেটিও তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। আমার মন খারাপ ছিল এ ঘটনায়। কারণ এটি আমার খুবই প্রিয় একটি যন্ত্র ছিল। এর বদলে নতুন ও উন্নত একটি খোল পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।'

গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল দাস বলেন, 'সংগঠনটি আমার গ্রামের দুটি পরিবারকে সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র ও দুটি নলকুপ দিয়েছে। এসব পেয়ে তারা খুবই খুশি। নলকূপ দুটিতে বেশ কয়েকটি পরিবারের মানুষজন বিশুদ্ধ জল খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। যারা এগুলো দিলেন, আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।'

ইস্টহ্যান্ডসের চেয়ারম্যান নবাব উদ্দিন বলেন, 'মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ ও আফ্রিকায় কাজ করে যাচ্ছে ইস্টহ্যান্ডস। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো মানবতার জন্য কাজ করা। শাল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। মানুষের মনের ক্ষতি কখনও পোষাবার নয়। তবে আমরা তাদের জীবনের প্রয়োজনে দুটি নলকূপ ও দুটি পরিবারকে বাদ্যযন্ত্র কিনে দিয়েছি। আগামীতেও আমরা মানুষের পাশে মানুষের আনন্দে এভাবে কাজ করে যাব।'

 

এসএস/আরআর-০৮