শামস শামীম, সুনামগঞ্জ
এপ্রিল ১৯, ২০২১
০৫:২৩ পূর্বাহ্ন
আপডেট : এপ্রিল ১৯, ২০২১
০৫:৪০ পূর্বাহ্ন
দেশব্যাপী বোরো ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জ। জেলার প্রায় আড়াই লাখ চাষি পরিবার বোরো চাষে জড়িত। হাওর থেকে বছরে প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অর্ধেকেরও বেশি চাল উদ্ধৃত্ত থাকে। তাই কোনো দুর্যোগে হাওরের ফসলহানি ঘটলে জাতীয়ভাবে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। করোনা মহামারিকালে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের মধ্যেই কৃষক এবার ধান কাটা শুরু করেছেন। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলায় ৪.৫ ভাগ ধান কাটা হয়েছে। শ্রমিক সংকটের কারণে বিভিন্ন স্থানে ধানকাটা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। তবে হাওরের ধান যাতে দ্রুত কাটা হয়, সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৪৩টি ধান কাটার মেশিনসহ বাইরের জেলা থেকে ৪ হাজারেরও অধিক শ্রমিক হাওরে নিয়ে আসা হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই হাওরে ধান কাটার ধুম পড়বে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ধান কাটার মৌসুমে সুনামগঞ্জের বাইরের জেলার হাজার হাজার মৌসুমী শ্রমিক ধান কাটতে আসতেন। পরে তাদের আর্থসামাজিক উন্নতির কারণে শ্রমিক আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। গতবছর করোনা মহামারির কারণে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসা হয়। এবারও সরকারিভাবে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, পাবনাসহ কয়েকটি জেলা থেকে ৪ হাজার ১০৩ জন শ্রমিক এসেছেন হাওরে। আরও কয়েকটি জেলার শ্রমিকরাও কিছুদিনের মধ্যে এসে হাওরে ধান কাটায় যুক্ত হবেন বলে জানা গেছে। সরকার মহামারি করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে যে লকডাউন ঘোষণা করেছে, তা হাওরের শ্রমিকদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোনো মূল্যে হাওরের বোরো ধান কাটতে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর আগে হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় তিনি এ বছর ১৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার পর এখন ফসল পাকার উপক্রম হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় কৃষকদের কষ্টের ধান যাতে শ্রমিকের অভাবে ক্ষেতে নষ্ট না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিদিনই তার নির্দেশনা মেনে কৃষি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা হাওরে ঘুরছেন।
ইতোমধ্যে হাওরের ধান কাটতে সরকারিভাবে ৮৯টি ধান কাটার মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। গতবারের বিতরণকৃত আরও ১২৯টি মেশিন হাওরে কাজ করছে। তাছাড়া কৃষকদের অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরও ২৫টি মেশিন হাওরে নামিয়েছেন। স্থানীয় ১ লাখ ৮৩ হাজার শ্রমিকও ধান কাটছেন বিভিন্নভাবে। তাছাড়া স্থানীয় বালু ও পাথরমহাল বন্ধ থাকায় সেখানকার শ্রমিকরাও হাওরের ধান কাটায় এসে যুক্ত হবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাওরের কৃষকরা জানিয়েছেন, এ বছরের মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ধানের ফলন কমেছে। অনেকের ক্ষেত পরাগায়নের সময় গরম বাতাসে নষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া কম-বেশি সব কৃষকের জমিতে বৃষ্টির অভাব বাম্পার ফলনে প্রভাব ফেলেছে বলে জানিয়েছেন তারা। তবে কৃষি বিভাগ বলছে এতে বাম্পার ফলনে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না। পুরো ফসল গোলায় তুলতে পারলে লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে না।
কৃষি বিভাগের মতে, জেলায় চলতি বছর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর। এর মধ্যে আছে বিআর ২৮ ধান ৬৭ হাজার হেক্টর এবং বিআর ২৯ ধান ৬৩ হাজার হেক্টর। বাকি ধানের মধ্যে হাইব্রিডসহ কিছু দেশীয় প্রজাতিও রয়েছে। বর্তমানে বিআর ২৮ ও দেশি প্রজাতির ধান কাটছেন কৃষকরা। দেশি প্রজাতির ধান কেটেই হাওরের চাষিরা নিদান দূর করেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটার ধুম পড়বে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বৈশ্বিক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের গাণিতিক মডেল পর্যালোচনা করে পূর্বাভাস দিয়েছে, ১১ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাত হবে। হাওরের মাথার উপর অবস্থিত আসাম, ত্রিপুড়া ও মেঘালয়েও বৃষ্টিপাত হবে। এতে হাওরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা হতে পারে। কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ভারতের মেঘালয় ও আসামে ভারী বৃষ্টিপাত হলে সুনামগঞ্জে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে তা হাওরে প্রবেশ করে বোরো ফসল ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। যে কারণে হাওরে ফসলহানির আশঙ্কা থাকে। যার ফলে কৃষকরাও উদ্বিগ্ন থাকেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরের বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক নূরুল হক বলেন, 'আমি এক সপ্তাহ আগেই বিআর ২৮ ধান কাটতে শুরু করেছি। ধীরে ধীরে আমার অন্য ক্ষেতের ধানও পাকছে। তবে কাঙ্খিত শ্রমিক মিলছে না। এ বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ধানে কিছুটা চিটা দেখা যাচ্ছে। এখন দিন ভালো থাকলে আশা করি সব ফসল কাটতে পারব।'
শাল্লা উপজেলার উদগল হাওরের রামপুর গ্রামের কৃষক ঝান্টু কুমার দাস বলেন, 'আমাদের হাওর এখনও প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের মুখে পড়েনি। আমি ৬০ শতক দেশি বোরো ও ৯০ শতক হাইব্রিড ধান কেটেছি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের হাওরে ধান কাটার ধুম পড়বে।'
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, 'ধান কাটতে বাইরের জেলা থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার পাশাপাশি প্রায় আড়াইশ ধান কাটার মেশিন হাওরে রয়েছে। এ মাসের মধ্যেই আমরা আশা করছি ৮০ ভাগ ধান কাটা শেষ হবে।'
তিনি বলেন, 'অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টিতে ধানে কিছু চিটা হয়। তবে এবার হাওরের গড় ফলনে এতে কোনো প্রভাব পড়বে না। শ্রমিকেরও অভাব হবে না। প্রাকৃতিক বড় দুর্যোগ না এলে এবারও কাঙ্খিত ফলন আসবে হাওর থেকে।'
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাওরবাসীর প্রতি খুবই আন্তরিক। হাওরের ফসল গোলায় তুলতে সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। একসময় বাইরের জেলার শ্রমিকরা আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু গতবছর থেকে তারা আবার আসতে শুরু করেছেন। তাই আমাদের ফসল কাটার ব্যাপারে উদ্বেগ কমেছে। এবারও হাওরবাসীর মুখে হাসি ফোটাবে বোরো ধান।'
এসএস/আরআর-০৪