বিপথগামী শিক্ষার্থীরা, দুশ্চিন্তায় অভিভাবক

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


এপ্রিল ২৮, ২০২১
০২:২০ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৮, ২০২১
০২:২০ পূর্বাহ্ন



বিপথগামী শিক্ষার্থীরা, দুশ্চিন্তায় অভিভাবক

মহামারি করোনায় ভেঙে পড়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। করোনা আতঙ্কে দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে দীর্ঘদিনের বিরতি চলতে থাকায় পড়ালেখার আগ্রহ হারিয়েছে শিশু-কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীরা। পড়ালেখায় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন এসব ছাত্রছাত্রীর মাঝে মোবাইল আসক্তি প্রচণ্ডভাবে ভর করেছে। এতে তাদের মাঝে উটকো চিন্তা-চেতনা জন্ম নেওয়ার পাশাপাশি স্বভাব-চরিত্র ও আচরণগত ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যাতে করে উঠতিবয়সী শিক্ষার্থীরা বিপথগামী হচ্ছে এবং ঝরে পড়ার সম্ভাবনাও প্রবল হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকমহল চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাই বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে।

গতবছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তীতে করোনা সংক্রমণের গতিবিধি অনুসরণ করে ধাপে ধাপে ছুটি বাড়ানো হয়। এ ছুটি চলাকালে জেএসসি, জেডিসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম। এছাড়া শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি তাদের মাঝে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষক-অভিভাবক উভয়েই।

স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে সুনামগঞ্জ পশ্চিম নতুন পাড়ার বাসিন্দা ব্যাংকার ও অভিভাবক রবীন্দ্র কুমার দাস জানিয়েছেন, শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এই করোনাকালে সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিপথে হাঁটছে। করোনা আছে এবং থাকবে, তাই বলে জীবন তো আর থেমে থাকছে না। করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করে লেখাপড়াটাকেও এগিয়ে নিতে হবে। নইলে ছাত্রছাত্রীরা দিন দিন অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাবে।

জামালগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী অন্বেষা চৌধুরী পূজা জানায়, স্কুল না থাকায় পড়ালেখাও তেমন একটা হচ্ছে না তার। স্কুলে নিয়মিত ক্লাস করলে রুটিন মোতাবেক প্রতিদিন পড়া সম্পন্ন করতে হয়। করোনার বন্ধে এখন আর সে চাপ নেই। তাই পড়ালেখাও পিছিয়ে পড়ছে। তাড়াতাড়ি স্কুল খোলার প্রত্যাশা রেখে সে দ্রুত স্কুলমুখী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

জামালগঞ্জ কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড জুনিয়র হাইস্কুলের কমিটির অভিভাবক সদস্য এম আল আমীন বলেন, 'স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা পড়তে বসতে চাইছে না। পড়ার জন্য ধমক দিলে উল্টো কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। যদি স্কুল খোলা থাকত তাহলে আমার মেয়েটা প্রতিদিন স্কুলে যেত এবং পড়াতেও মনোযোগী থাকত। এভাবে দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ থাকলে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বলতে কিছু থাকবে না। এখন আর করোনার চিন্তা না করে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া দরকার।'

সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. ফয়জুর রহমান বলেন, 'শিক্ষার্থীরা দীর্ঘসময় ধরে পড়ালেখার টাচে না থাকায় এতে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। বর্তমানে তারা অলস সময় পার করছে। যে সময়টা তাদেরকে পথভ্রষ্টের সম্ভাবনায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইলের নেশাটা ছাত্রছাত্রীদের বেশি বিপথগামী করছে। অনলাইন ক্লাসের জন্য তাদেরকে যে মোবাইল কিনে দেওয়া হয়েছে, সেটা পড়ালেখার চেয়ে মন্দ কাজে ব্যবহার করছে বেশি। ছাত্রছাত্রীদের বাজে নেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে সীমিত পরিসরে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীরা যদি সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন শিক্ষকদের সংস্পর্শে থাকে, তাহলে তাদের বিপথগামীতা কিছুটা হলেও কেটে যাবে। এজন্য অভিভাবকদেরও লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের সন্তান কখন কী করছে।'

জামালগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান ভূষণ চক্রবর্ত্তী বলেন, 'করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিদ্যালয় বন্ধ আছে। বর্তমানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি জীবন পার করছে। তাই অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর মানসিক বিকাশজনিত বিভিন্ন সমস্যা ছাড়াও বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এজন্য অভিভাবকরা গৃহবন্দি সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি পাঠ্যবইসহ বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস ও ধর্মীয় বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে।'

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলার শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগী করতে স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম চালু আছে। শিক্ষকরা বাড়িতে অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছেন আর শিক্ষার্থীরা বাড়িতে পরীক্ষা দিয়ে সেটা স্কুলে জমা দিচ্ছে। এছাড়া গত সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসক স্যারের কাছে বিটিভিতে ক্লাস কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছি।'

তিনি অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, 'ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখায় মনোনিবেশ ঘটাতে বাড়ির কাজের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য শিক্ষকদের এলাকা ভাগ করে তাদের সেখানে গিয়ে শিশুদের পড়ালেখার প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে পারলে হয়তো মোবাইলে আসক্তি কিছুটা দূর হবে। রমজানের পরে এই হোম ভিজিট কার্যক্রম জোরদার করা হবে।'

 

বিআর/আরআর-০১