কৃষি যান্ত্রিকীকরণে কমেছে ধানের উৎপাদন খরচ

সোহেল তালুকদার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ


এপ্রিল ২৮, ২০২১
১০:৩২ অপরাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৮, ২০২১
১০:৩২ অপরাহ্ন



কৃষি যান্ত্রিকীকরণে কমেছে ধানের উৎপাদন খরচ

সুনামগঞ্জের একমাত্র বোরো ফসল চাষাবাদ থেকে ধান কর্তন, মাড়াই ও গোলায় ওঠানো পর্যন্ত কৃষকদের শ্রমিক সংকট নিত্যদিনের। ব্যাপারীকে আগাম বায়নার টাকা দিয়েও ধান কাটার শ্রমিক মেলানো খুবই দুষ্কর। পাশপাশি হাওরে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটাতে সময় লাগে বেশি। আবার এক সঙ্গে ধান কাটা শুরু হলে সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাওয়া যায় না পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্রমিক। এতে করে অকাল বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি থাকে শতভাগ। তবে দ্রুত সোনালি ফসল ঘরে তুলতে এবার শ্রমিক সংকট মেটাচ্ছে সরকারের ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা ধান কাটার মেশিন কম্বাইন হারভেস্টার। কৃষকরা কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে একই সঙ্গে ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের কাজ করছেন। কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটায় কমছে কৃষকদের উৎপাদন খরচ। অল্প সময়ে অধিক জমির ধান কর্তন করতে পেরে খুশি স্থানীয় কৃষকরা। এতে করে শ্রমিক সংকট মেটার পাশাপাশি বোরো ধান উৎপাদনে খরচ কমবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় হাওরপাড়ের একাধিক কৃষক।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, উপজেলায় মোট কৃষিজমির পরিমাণ ২২ হাজার ২০ হেক্টর। চলতি বছর ২২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ফসলের আবাদ করা হয়েছে। এতে কৃষি বিভাগ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এবার উপজেলায় হাইব্রিড জাতের ধান ১ হাজার ৮৬০ হেক্টর, উফশী, ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান ১ হাজার ৯৮৭ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের ধান ৬১০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়েছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলায় শ্রমিক সংকট নিরসনে উপজেলার বিভিন্ন কৃষকের মাঝে উপজেলা কৃষি বিভাগ চলতি বছর সরকারি ভর্তুকি মূল্যে ১০টি ও গেল বছর আরও ৮টি কম্বাইন হারভেস্টার (ধান কাটার মেশিন) বিতরণ করেছে। 

বোরো ধান কাটতে গিয়ে শ্রমিক সংকটের কারণে হিমশিম খেতে হয় স্থানীয় কৃষকদের। জেলাজুড়ে এক সঙ্গে ধান কাটার মৌসুম শুরু হওয়ার কারণে শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যায়। আর চাহিদার পাশাপাশি বেড়ে যায় শ্রমিকের পারিশ্রমিকও। এতে করে বোরো ধান উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয় কৃষকদের। তবে এবার কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনে খুব সহজেই ধান কর্তন করে ঘরে তুলতে পারছেন এখানকার কৃষকরা। 

কৃষি বিভাগ বলছে, আগে যেখানে এক কেদার জমির ধান কর্তন করতে ধান কাটার শ্রমিক নিতে হতো, এখন একটি হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ঘণ্টায় তিন থেকে চার বিঘা জমির ধান অনায়াসেই কর্তন করা যাচ্ছে। এতে করে ৮ থেকে ১০ লিটার ডিজেল খরচ হয়। আর প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্যে মাত্র ৬৫ টাকা। এতে করে ৮ থেকে ১০ লিটার ডিজেলের মূল্যে আসছে মাত্র ৬৫০ টাকা। কিন্তু এই তিন থেকে চার বিঘা জমির ধান শ্রমিক দিয়ে কাটতে গেলে বিঘাপ্রতি কৃষককে খরচ করতে হতো তিন থেকে চার হাজার টাকা। দূরত্বভেদে খরচ বেড়ে যায় আরও বেশি। এতে করে ধান উৎপাদনে খরচও বেড়ে যায়। 

নাগডোরা হাওরের সদরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল হক বলেন, 'সরকারের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে এবার একটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ক্রয় করেছি। এ বছরের বৈশাখ মাসের ১০/১২ দিনের মধ্যে আমার সকল জমির ধান কর্তন করেছি এবং ধান সঙ্গে সঙ্গে খলায় শুকিয়ে গোলায় তুলে ফেলেছি। পাশাপাশি একটু বাড়তি লাভের আশায় অন্যান্য কৃষকদের জমির ধান আমার মেশিন দিয়ে কর্তন করে অর্থ উপার্জন করছি। সরকারের এ উদ্যোগের ফলে সুনামগঞ্জের কৃষকদের ফসল আবাদের খরচ অনেকাংশে কমে যাবে। শ্রমিক সংকটে আমাদের দুশ্চিন্তায় পড়তে হবে না।' 

দেখার হাওরের আস্তমা গ্রামের কৃষক আব্দুল অদুদ বলেন, 'প্রতি বছর বোরো ধান কর্তন করার সময় শ্রমিক সংকটে ভুগতে হতো। শ্রমিকদের বৈশাখের ২/৩ মাস আগে থেকে টাকা দিয়ে বায়না করে ব্যাপারীকে রাখতে হতো। এখন এ সমস্যাটা দিন দিন কমে যাচ্ছে। সরকার কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি আনার ফলে আমাদের জমি চাষাবাদ থেকে শুরু করে ধানের গোলায় ওঠানো পর্যন্ত খরচ অনেকাংশ কমে যাবে।' 

উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'এ উপজেলায় প্রতিবছরই বোরো ধান কাটতে শ্রমিক সংকট তীব্র আকার ধারন করে। কৃষকরা শ্রমিক সংকটের কারণে সময়মতো ধান ঘরে তুলতে পারতেন না। যার কারণে অকাল বন্যায় কৃষকদের ধানের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা থেকে যেত। তবে গত দুই বছর ধরে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়ে খুব দ্রুত কৃষকরা ধান ঘরে তুলতে পারছেন। একটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন এক ঘণ্টায় ৩ বিঘা জমির ধান কাটতে পারে। অথচ শ্রমিক দিয়ে কাটলে ৪ থেকে ৬ জন শ্রমিক সারাদিন ১ বিঘা জমির ধান কাটতে পারেন। এতে করে প্রচুর সময়ে লেগে যায়। খরচও বাড়ে কৃষকদের। এজন্য কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসারে প্রতিটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের দাম যেখানে ২৯ থেকে ৩০ লাখ টাকা, সেখানে সরকার প্রতিটি মেশিনের ওপর ১৪ লাখ টাকা করে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই মেশিনের আমদানি খরচ কমানো সম্ভব হলে প্রান্তিক চাষি পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব।'

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা সজিব আল মারুফ বলেন, 'চলতি বছর বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থেকে উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অধিকাংশ কৃষক আগাম জাতের ব্রি ২৮, ২৯ ও হাইব্রিড এলসি-৮ জাতের ধান চাষাবাদ করেছেন। গতকাল সোমবার পর্যন্ত স্থানীয় কৃষকরা ৮৫ ভাগ এবং হাওরের বাইরে ৩০ ভাগ ধান কেটে ফেলেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী সপ্তাহের মধ্যে সব ধান কেটে ঘরে তুলতে পারবেন কৃষকরা। 

করোনাকালীন অনেক কৃষক শ্রমিক সংকটে হতাশ ছিলেন। সরকার এ উপজেলায় চলতি বছর ১০টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন কৃষকদের মাঝে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করেছে। আশা করি আগামী দিনে কৃষকদের ফসল আবাদে উৎপাদন খরচ কমে আসবে। ধান দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘরে তুলতে পারবেন তারা।' 

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কালাম সিলেট মিররকে বলেন, 'বর্তমান সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। কৃষকের কথা মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষকদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন বিতরণ করছেন। এই মেশিনের কারণে বাংলাদেশের কৃষকরা আরও একধাপ এগিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী চাইছেন কৃষিখাতকে পুরোপুরি যান্ত্রিকীকরণের আওতায় নিয়ে আসতে। সেজন্য প্রতিবছর ভর্তুকি মূল্যে ব্যাপকভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হচ্ছে। আর দিনে দিনে কৃষিখাত যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন কমে আসছে, তেমনি শ্রমিক সংকটও দূর হচ্ছে।'

 

এসটি/আরআর-০২