লাউয়াছড়ায় অগ্নিকাণ্ড বন বিভাগের অবহেলায়

কমলগঞ্জ প্রতিনিধি


এপ্রিল ২৯, ২০২১
০১:৩৮ পূর্বাহ্ন


আপডেট : এপ্রিল ২৯, ২০২১
০১:৩৮ পূর্বাহ্ন



লাউয়াছড়ায় অগ্নিকাণ্ড বন বিভাগের অবহেলায়

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আগুন লাগার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিসে জমা দিয়েছে। বুধবার (২৮ এপ্রিল) দুপুরে তারা প্রতিবেদনটি জমা দেন বলে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদি সরোয়ার।

তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে আগুন লাগার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, বাঘমারা বন ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনপ্রহরী মোতাহার হোসেন ও সহযোগী কমিটি লাউয়াছড়া কমিউনিটির টহলদার সদস্য মো. মহসিনকে দায়ী করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঘটনাস্থল এলাকায় ২০২০-২০২১ মৌসুমের জন্য বনায়ন করার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সেখানকার আগাছা ও ঝোঁপ-ঝাড় পরিষ্কার করা হচ্ছিল। এখানে বনায়নের মধ্যে বন্যপ্রাণীর খাবার উপযোগী গাছও রোপণ করা হবে। তবে ঝোঁপ-ঝাড় পরিষ্কারকালে বনের যেন কোনোরূপ ক্ষতি না হয় এবং আগুন ও মাটির নিচ দিয়ে যাওয়া গ্যাস লাইনের বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকার কথা। এসব তদারকির দায়িত্ব ছিল লাউয়াছড়া বনবিট কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, বাঘমারা ক্যাম্পের বনপ্রহরী মোতাহের হোসেন ও কমিউনিটি টহলদার দলের সদস্য মহসিন মিয়ার। 

তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে মোট ১০টি পয়েন্ট উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে ৭ এবং ৮ নম্বর পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানোর ঘটনার প্রমাণ সেভাবে মেলেনি। তবে বনে কোনো ময়লা বা আগাছায় কোনোভাবেই আগুন দেওয়া যাবে না বলে পূর্বেই নির্দেশ দিয়েছিলেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা। তাই আগুন লাগার ঘটনায় নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে।

এ ঘটনায় দায় দেওয়া হয়েছে বন বিভাগের ৩ জনের ওপর। তাদের একজন বাঘমারা ক্যাম্পের বনপ্রহরী মোতাহার হোসেন। বনায়নের জন্য শ্রমিকরা যখন লতা-পাতা পরিষ্কার করার কাজ করছিলেন, তখন তা তদারকির দায়িত্বে ছিলেন মোতাহার হোসেন। কিন্তু আগুন লাগার পর তিনি তা নেভাতে নিজে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি এবং নিজে থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করেননি। কীভাবে আগুন লাগল, তা তিনি দায়িত্বে থেকেও বলতে পারছেন না। একই রকম দায় রয়েছে লাউয়াছড়ার বিট অফিসার মিজানুর রহমানের। আগুন লাগার ঘটনায় তিনিও কোনো পদক্ষেপ নেননি। সেদিন যে শ্রমিকরা কাজ করছিলেন এবং আগুন লাগার ঘটনাসহ সার্বিক ঘটনায় তার তদারকির অভাব পরিক্ষিত হয়েছে তদন্ত কমিটির তদন্তে। অন্যদিকে বনবিভাগের আরেক সহযোগী সদস্য (কমিউনিটি পেট্রোল দল) মো. মহসিন। কাজের তদারকি করার দায়িত্ব তার থাকলেও আগুন লাগার সময় বা পরে ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরে যান তিনি। আগুন নেভানোর কোনো উদ্যোগ যেমন নেননি, তেমনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করেননি। এই তিনজনের দায়িত্বে থেকে তাদের দায়িত্ব পালন না করা, আগুন লাগার পর তা নেভানোর চেষ্টা না করে ঘটনাস্থল থেকে দূরে চলে যাওয়া, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত না করাসহ বিভিন্ন কারণে তদন্ত কমিটি এ ঘটনার জন্য তাদেরকেই দায় দিয়েছে। 

ঘটনাস্থলে তারা তিনজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, কিন্তু আগুন লাগার ঘটনাটি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অন্য সূত্র থেকে জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে লাউয়াছড়ার রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামকে দ্রুত আগুন নেভানোর নির্দেশ দেন। বিভাগীয় বন কর্মকর্তার মাধ্যমে খবর পেয়ে রেঞ্জ কর্মকর্তা স্টাফ নিয়ে আগুনের সম্মুখভাগে ফায়ার লাইন কাটাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। সেই সঙ্গে যোগ দেয় কমলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস। বন বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিসের যৌথ প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

প্রতিবেদনে আগুন লাগার সময় বলা হয়েছে দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টা এবং আগুন নিভে যায় বেলা ২টা ২০ মিনিট থেকে আড়াইটার ভেতরে। একই সঙ্গে তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন উল্লেখ করেছেন, আগুনের সূত্রপাত বনায়নের জায়গা থেকেই। এতে পুড়েছে দেড় একর জায়গা, তবে তেমন বড় কোনো গাছ পুড়েনি। যে জায়গায় বনায়ন করা হবে, সে জায়গা পোড়ায় তা বনায়নের মাধ্যমে এবং অন্য জায়গায় বৃষ্টি হলেই নতুন গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মাবে।

তদন্ত কমিটি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বন বিভাগের স্টাফদের ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া গাছ ও লতাপাতার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। বনের উন্নয়নমূলক কাজের সময় গ্যাস লাইটার বা দিয়াশলাই সঙ্গে রাখা যাবে না। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সঙ্গে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আশপাশের ফায়ার স্টেশনের মোবাইল নম্বর সঙ্গে রাখতে হবে।

এদিকে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আমলে নিয়ে দায়িত্বে অবহেলার কারণে ৩ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, 'প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বন বিভাগের নিয়ম অনুসারে এই ৩ জনের বিরুদ্ধে বিবাগীয় ব্যবস্থা নেব। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু না ঘটে, সেজন্য তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করছে তা আমলে নিয়ে আরও বেশ কিছু বিষয় নিজে থেকে যুক্ত করব। সব কথার শেষ কথা হলো সবার আগে বন। বনকে রক্ষা করতে হবে। এখানে কারও অবহেলা সহ্য করা হবে না এটা নিশ্চিত।'

উল্লেখ্য, গত ২৪ এপ্রিল কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানের স্টুডেন্ট ডরমেটরি অংশের পাশে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হীড বাংলাদেশ সংলগ্ন বাঘমারা এলাকায় কাজ করছিলেন কিছু শ্রমিক। সেখানে আগাছা পরিষ্কার করে বন্যপ্রাণী খায় এমন ফলের গাছ লাগানোর জন্য বন বিভাগের অধীনে কাজ করছিলেন তারা। ওই জায়গায় দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হয় এবং বেলা আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। এ ঘটনার তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে বন বিভাগ।

 

এসডি/আরআর-০৯