কাজ হারিয়ে বিপাকে সুনামগঞ্জের রেস্তোরাঁ শ্রমিকরা

সাইদুর রহমান আসাদ, সুনামগঞ্জ


মে ০১, ২০২১
১১:৩৬ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০১, ২০২১
১১:৩৬ অপরাহ্ন



কাজ হারিয়ে বিপাকে সুনামগঞ্জের রেস্তোরাঁ শ্রমিকরা

বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সারাদেশের শ্রমিকরা প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস তথা মে দিবস পালন করেন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন এটি। কিন্তু এবার এমন এক সময়ে দিবসটি এসেছে, যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সারাদেশের মতো সুনামগঞ্জও 'কঠোর লকডাউনের' বিধিনিষেধের চাদরে মোড়া। দোকান ও শপিংমল খুললেও এখনও বন্ধ রয়েছে রেস্তোরাঁগুলো। এতে এসব রেস্তোরাঁর শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছেন। অনেক শ্রমিক ইতোমধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের কলকলিয়া ইউনিয়নের জগদিশপুর গ্রামের রেস্তোরাঁ শ্রমিক মো. লিটন মিয়া বলেন, 'এক মাসের বেশি হয়েছে কোনো বেতন পাই না। বেতন না পেলে চলা সম্ভব নয়। এখন হাত পাতার মানুষও নেই। সবারই এক অবস্থা, হাত খালি। তারা নিজেরাই টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছে।'

জানা গেছে, একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করেন লিটন মিয়া। রেস্তোরাঁয় কাজ করে সামান্য উপার্জনেও ভালোই চলছিল তার পরিবার। তাই সুখের সংসারের স্বপ্ন বুনছিলেন। দুই বছর আগে তিনি বিয়ে করেছেন। নতুন বউয়ের হাতের মেহেদীর রং শুকানোর আগেই করোনার থাবায় তার পরিবারে আলো কমে অন্ধকার নেমে আসে। করোনার প্রথমদিকে টানা 'লকডাউনের' সময় পরিচিত স্বচ্ছল আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে চালিয়েছে সংসার। অনেক সময় ধার-দেনাও করেছেন। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে আবারও রেস্তোরাঁয় কাজ করে পরিবারের হাল ধরেন। কিছু ঋণ পরিশোধও করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আবারও লকডাউনে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ হওয়ায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি।

মো. লিটন মিয়া বলেন, 'হোটেলে সামান্য বেতনে এমনিতেই পোষায় না। ওয়েটারের কাজ করি। সার্ভিসে খুশি হয়ে মানুষ বখশিশ দেয়। এই টাকায় পরিবার কোনোরকমে চলে যায়। দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের সময় অনেকদিন না খেয়ে ছিলাম। মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না লজ্জায়। নিজের একটা ছোট গরু ও ছাগল ছিল। গরুটা বিক্রির বয়স হয়নি। তবু ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। আর ছাগলটা বেচে দিয়েছি সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। এই সাড়ে ১৯ হাজার টাকায় পরিবার চালাচ্ছি এখন।'

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো সুনামগঞ্জ জেলাইয় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন কারিগর, বাবুর্চি, ওয়েটার ও ম্যানেজার। বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে 'লকডাউনে' সব রকমের হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হওয়ায় বেতন পাচ্ছেন না তারা। অনেকের লকডাউনের আগে থেকেই বেতন বন্ধ।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. মানিক মিয়া। তিনি শহরের মৌল্লার হোটেলের বাবুর্চি। তার দুই মেয়ের একজন সুমাইয়া আক্তার শিমু সুনামগঞ্জ শহরের একটি উচ্চবিদ্যালয়েরর ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। আরেকজন পিটিআই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সঙ্গে বৃদ্ধ মা থাকেন। তার ৫ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। পরিবারের সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে না পারলেও হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেই সংসার চালান। এতে এমনিতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। লকডাউনে হোটেল বন্ধ থাকায় আর্থিক সংকটে পড়েছেন তিনি।

মানিক বলেন, 'বাচ্চাকাচ্চা এখন বড় হয়েছে। চাইলেই মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না। লকডাউনে হোটেল বন্ধের সঙ্গে আমাদেরও বেতন বন্ধ হয়েছে। এতে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। নিজের পরিবার নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। কাউকে বলতেও পারছি না, আবার সইতেও পারছি না।'

আরেক রেস্তোরাঁ শ্রমিক কাজল দাস বলেন, 'আমি সিলেটের আল-মদিনা হোটেলে কাজ করতাম। হোটেল বন্ধ হওয়ায় পর অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে মালিক। আমাকেও ছাঁটাই করা হয়েছে। কাজ হারিয়ে বাড়িতে এসেছি। এখন আমি বেকার। কিছু জমানো টাকা ছিল, সেটা ভেঙে চলছি। নিজের কিছু বেচে দেব সেরকম কোনো সম্পদও নেই। এ রকম চলতে থাকলে কিছুদিন পর না খেয়ে থাকতে হবে।'

এদিকে জেলার শ্রমিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, এই লকডাউনে হোটেলের মালিক অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে। যে হোটেলে ৪০ জন শ্রমিক ছিল, সেখানে আছে এখন ১০ জন। কারণ মালিকের দোকান বন্ধ। এত শ্রমিকের বেতন দিতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ।'

বাংলাদেশ হোটেল মিষ্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়ন সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মো. লিলু মিয়া বলেন, 'পুরো জেলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ হোটেল মিষ্টি বেকারির শ্রমিক রয়েছে। লকডাউনে সব বন্ধ। কারও বেতন হচ্ছে না। সামনে ঈদ। সবার বউ-বাচ্চা রয়েছে। তারা কীভাবে ঈদ করবে? সরকারের বিধিনিষেধ আমরা মানছি। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো যে রয়েছে, তাদের নিয়ে কীভাবে চলব সেটা কেউ ভাবছে না। সরকার কয়েক দফায় লকডাউন দিয়েছে। অনেক সেক্টরের মানুষকে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমাদের জন্য কিছুই দেয়নি। আমাদের শ্রমিকরা খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছে।' এ সময় তিনি সরকারের প্রতি সুনামগঞ্জের হোটেল মিষ্টি বেকারি শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'আমরা সুনামগঞ্জ পৌরসভার ভেতরে বিভিন্ন সেক্টরের প্রায় সাড়ে ৭শ শ্রমিকদের ত্রাণ সহায়তা দিয়েছি। এর পরেও যারা পাননি তাদেরকেও দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা করেছেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র। তবু কেউ যদি বাদ পড়েন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা সহায়তা করব।'

 

এএম/আরআর-০৪