সুনামগঞ্জের চাষিদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে চিনা বাদাম

শামস শামীম, সুনামগঞ্জ


মে ০৯, ২০২১
১০:৫১ অপরাহ্ন


আপডেট : মে ০৯, ২০২১
১০:৫১ অপরাহ্ন



সুনামগঞ্জের চাষিদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে চিনা বাদাম

পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে আসা পলি ও বালুতে সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকার ভরাট কিছু জমি এখন কৃষকের কাছে আশির্বাদ। সেখানে চিনাবাদাম ফলিয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। এ মৌসুমে পানি জমে না- এমন জমিতে বাদাম চাষ করে পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা। তাদের চোখে-মুখে এখন খেলা করছে সুখের হাসি। এখন দেখাদেখি অন্যরাও বাদাম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

কৃষকরা জানান, বাজারের বীজ দোকানিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তারা চিনা বাদাম চাষ করছেন। কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ পেলে তারা অভিজ্ঞতা অর্জন করে আরও বেশি বাদাম উৎপাদন করতে পারবেন বলে জানান।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে ৫টি উপজেলায় চিনা বাদাম চাষ হয়। আরও তিনটি উপজেলায়ও কিছু কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে বাদাম চাষ করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি বাদাম চাষ হচ্ছে তাহিরপুর উপজেলায়। জেলায় ২০২০-২০২১ আবাদ বছরে মোট ১ হাজার ৪১০ হেক্টর জমির মধ্যে ১ হাজার ১৮৫ হেক্টর বাদাম চাষ হয়েছে তাহিরপুরে। তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত নদী যাদুকাটা, রক্তি, বৌলাইর তীরঘেঁষা জনপদগুলোতে বাদাম চাষ করছেন চাষিরা। এছাড়া সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ২৫ হেক্টর, দোয়ারাবাজারে ৬৫ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুরে ৬৬ হেক্টর ও জামালগঞ্জে ৫৫ হেক্টর জমিতে বাদাম আবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ধর্মপাশা, ছাতক ও জগন্নাথপুর উপজেলার কিছু কৃষকও বাদাম চাষ করছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সুনামগঞ্জের চাষিরা দুই পর্যায়ে বাদাম চাষ করেন। একটির বীজ দিয়ে আরেকটি ফসল ফলান তারা। প্রথম দফা অক্টোবর মাসে বাদাম চাষ করা হয়। পরে এই বাদামের বীজ দিয়েই দ্বিতীয় দফায় জানুয়ারিতে আবারও চাষ করা হয়। ৮০-৯০ দিনের মধ্যেই বাদাম উত্তোলনের উপযোগী হয়।

বর্তমানে তাহিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় চাষিদের বাদাম তুলতে দেখা যাচ্ছে। যারা বাদাম তুলতে সহযোগিতা করছেন, তাদেরকেও ফসলের ১১টি ভাগ করে ১ ভাগ প্রদান করেন কৃষক। ফলে সহজেই এলাকার মানুষ কৃষককে এভাবে বাদাম তোলায় সহযোগিতা করে নিজেরাও লাভবান হচ্ছেন।

কৃষক ও কৃষি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিঘাপ্রতি ৫-৬ মণ বাদামের ফলন পাওয়া যায়। প্রতি মণ বাদাম সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেন কৃষকরা। প্রতি বিঘায় তাদের খরচ হয় ৮-৯ হাজার টাকা। আর প্রতি বিঘা থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকার বাদাম বিক্রি করা যায়। 

সুনামগঞ্জের বাদাম চাষি ও কৃষি বিভাগের মতে, সুনামগঞ্জের চাষিদের বাদাম ক্ষেত সবুজময় হলেও ফলন কম হয়। কারণ তারা নিয়মানুযায়ী পরিচর্যা করেন না। যার ফলে গাছগুলোর বৃদ্ধি দেখা গেলেও ফলন কম হচ্ছে। মূলত জিপসাম ও টিএসপি সার সময় ও পরিমাণমতো না দেওয়ায় ফলন কম হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি গ্রামের সফল বাদাম চাষি ফুল মিয়া (৫৫)। যাদুকাটা ও বৌলাই নদীর তীরের জমিতে একসময় অগ্রহায়ণ মাসের বাইন (লম্বা বিছানো ধান) চাষ করতেন তিনি। তার জমিগুলো পাহাড়ি ঢলে বালু ও পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ার পর গত ২০ বছর ধরে নিজ থেকেই বাদাম চাষ শুরু করেন। এ বছরও ১৫ বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছেন তিনি। এতে তার ১ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। তিনি আশা করছেন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বাদাম বিক্রি করবেন এবার।

ফুল মিয়া বলেন, ‘ইবার চিনা বাদাম করলাম ১৮ কিয়ার জমিনো। নিজের প্রশিক্ষণে করতাছি। যা বাদাম অয়, ভালাই অয়। সরকারি কুনু প্রশিক্ষণ-টশিক্ষণ পাই না। পাইলে ভালা অইতো।’

একই গ্রামের কৃষক সাহাবুল ইসলাম বলেন, ‘আমরার গেরামো ৬০-৭০ পরিবার বাদাম লাগায়। আমিও ইবার দেড় কিয়ার জমিনো বাদাম লাগাইছি। আমরা সবাই বাদাম লাগাইয়া লাভবান অইছি। আমরার গেরাম এখন বাদাম কইরা উন্নত।’ ধান থেকে বাদামের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা বাদাম চাষে ঝুঁকছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে, বাদাম তোলার মৌসুমে কৃষকদের ফসল মাঠে রেখে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। ভাগে বাদাম তুলে দেন এলাকার মানুষজন। ১১ টুকরি বাদাম তুললে এক টুকরি বাদাম পান উত্তোলনকারীরা। তাই এখন কৃষকের ক্ষেতে এলাকার দরিদ্র পরিবারের নারী-পুরুষদের নিয়ে বাদাম তুলে দিতে দেখা গেছে।

বালিজুরি গ্রামের কৃষক ফুল মিয়ার ক্ষেতে ভাগে বাদাম তুলে দিতে ২ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে এসেছেন একই গ্রামের রাজিয়া বেগম। তার মতো গ্রামের আরও অন্তত ১৫টি পরিবারের নারীরা সন্তানদের নিয়ে ক্ষেতে এসে ভাগের বিনিময়ে বাদাম তুলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরার এলাকাত বাদামোর ক্ষেত বালা অয়। সবাই তুইল্যা দেয়। গিরস্তে আমরারেও কিছু দেয়। আমরারও লাভ অয়।’

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, 'সীমান্ত এলাকার নদী তীরবর্তী বালুভূমিরকম ভূমিতে যেখানে পানি জমে না, সেই জমিতে বাদাম চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধানের তুলনায় বাদাম চাষে লাভ বেশি। তবে সুনামগঞ্জের চাষিরা পর্যাপ্ত পরিচর্যা করতে না পারায় কাঙ্ক্ষিত ফলন পান না। আমরা রবি মৌসুমে কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকি। তবে আমাদের মাঠ পর্যায়ে লোকবল না থাকায় সবার কাছে পৌঁছা সম্ভব হচ্ছে না।'

 

এসএস/আরআর-০১