খুন হয়েছেন বাবা-মা, অনিশ্চিত চার শিশুর ভবিষ্যৎ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


মে ১১, ২০২১
০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ১১, ২০২১
০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন



খুন হয়েছেন বাবা-মা, অনিশ্চিত চার শিশুর ভবিষ্যৎ

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে দুই পরিবারের শিশুদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে চাচাতো ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন ভাই ও ভাবি। গতকাল রবিবার (৯ মে) রাতে তারাবির নামাজ চলাকালে বেহেলী ইউনিয়নের বেহেলী আলীপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।

নিহতরা হলেন- মো. তাহির আলীর ছেলে মো. আলমগীর (৩৬) ও তার স্ত্রী মোছা. মুর্শেদা বেগম (৩২)। তাদের ২ ছেলে ও ২ মেয়েসন্তান রয়েছে। মর্মস্পর্শী এ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন নিহতের চাচা জনর আলীর ছেলে মো. রাসেল মিয়া (৩০)। এ ঘটনায় তিনিসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে একটি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। মামলার পর খুনির স্ত্রী বিপলুমা খাতুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।

নিহত দম্পতির ২ ছেলে ও ২ মেয়েসন্তান রয়েছে। বেহেলী আলীপুরে সংঘটিত এই জোড়া খুনের ফলে এতিম হয়ে পড়েছে লিমা আক্তার (১২), নাঈম ইসলাম (১০), অলিমা (৭) ও রাকিবুল হাসান (৫) নামের এই ৪ শিশুসন্তান। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন চরম শঙ্কিত দাদী গুলেমান বিবি।

সোমবার (১০ মে) সকালে শোকার্ত বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে ৫ বছরের শিশু রাকিবুল হাসানের খোঁজ মিলছে না। অবশেষে কেউ একজন খুঁজে নিয়ে আসেন তাকে। মা-বাবা হারানোর শোক স্পর্শ করতে পারেনি সদ্য এতিম এই শিশুটিকে। পরম মমতায় বেড়ে ওঠা শিশু রাকিব হয়তো ভাবছে তার মা-বাবা কোথাও বেড়াতে গেছেন। খেলার ছলে অন্য শিশুদের সঙ্গে দুষ্টুমিও করছিল সে। কিছুদিন পর যখন শিশু রাকিব মা-বাবার খোঁজ করবে, তখন কে সান্ত্বনা দেবে তাকে?

মা-বাবার করুণ পরিণতি নিয়ে শিশুকন্যা অলিমাও অনেকটা গরজহীন। প্রিয়জন হারানোর ব্যথা তেমনভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি তার ওপর। তবে মা-বাবাকে হারিয়ে অঝোরে কাঁদছিল বড় মেয়ে লিমা আক্তার ও শিশুপুত্র নাঈম ইসলাম। রাসেলের অমানবিক হত্যাকাণ্ডে আলমগীর-মুর্শেদা দম্পতির এতিম হয়ে পড়া এই শিশুসন্তানদের পাশে কে দাঁড়াবে, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দরজার সামনে বসে আহাজারী করছেন নিহত আলমগীরের মা গুলেমান বিবি। তার সঙ্গে কাঁদছে এতিম কন্যা লিমা আক্তার। পাশে নির্বাক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে ভাই নাঈম। তার চোখে-মুখেও আপনজন হারানোর কষ্ট ফুটে উঠেছে। কাছেই মাটিতে নীরবে বসে আছে শিশু অলিমা। পুরো বাড়িতেই যেন শোকার্ত পরিবেশ বিরাজ করছিল। ঘটনাস্থলে ভিড় করা মানুষের মনেও প্রশ্ন ছিল- এখন কে দেখবে এই এতিম শিশুদের?

শিশুদের দাদি গুলেমান বিবি বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, 'এখন আমি কী করমু? আমার পুত আর বৌরে খুনি রাসেল চাক্কু দিয়া খুন কইরা ফেলাইছে। আমার নাতি-নাতনীদের এতিম কইরা দিছে। ও আল্লাহ তুমি হের বিচার কইর।'

প্রত্যক্ষদর্শী ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রবিবার বিকেলে আলমগীরের ছেলে ও রাসেল মিয়ার ছোট ভাইয়ের মাঝে ঝগড়া বাঁধে। এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। ওইদিন রাতে রাসেল মিয়া ঘরে ফিরলে তার স্ত্রী তাকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ঘর থেকে বাইরে বের হন এবং আলমগীরদের গালিগালাজ করতে থাকেন। এ সময় নিজ ঘরে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন আলমগীর। গালাগালির একপর্যায়ে আলমগীরের স্ত্রী এতে প্রতিবাদ জানান। এ সময় রাসেল মিয়া রাগে ঘরে ঢুকে মুর্শেদাকে ছুরিকাঘাত করেন। আলমগীর স্ত্রীকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে রাসেল তাদের দু'জনকেই উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকেন। এতে রক্তাক্ত জখম অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে আলমগীরের পিতা প্রতিবেশীদের সহায়তায় গুরুতর আহত দু’জনকে উপজেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদেরকে মৃত ঘোষণা করেন। গতকাল সোমবার সকালে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ দু’টি সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।

এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, শিশুদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে প্রায় সময়ই এ দুই পরিবারের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকত। তবে নিহত আলমগীর খুব নিরীহ ও ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ ছিলেন। ঘটনার রাতে যখন রাসেল তাদের ওপর চড়াও হন, তখন পরিবেশ অনেকটা নীরব ছিল। কারণ এ সময় পার্শ্ববর্তী মসজিদে অনেকেই তারাবীর নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। নামাজ শুরু হওয়ামাত্র ঘটনাটি ঘটান খুনি রাসেল। এরপর তার মা বেহেলী বাজারে দৌড়ে এসে ছেলেকে মেরে ফেলছে বলে মানুষের সাহায্য চান। এর ফাঁকেই খুন হন আলমগীর ও তার স্ত্রী মুর্শেদা বেগম।

অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, জায়গা বিক্রি নিয়ে দুই পরিবারের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে ঝগড়া-বিবাদ চলে আসছিল। বিবাদকৃত জায়গাটি রাসেলের বাবা জনর আলী একই গ্রামের শহীদ মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় জনর আলীর বোন জনর আলীকে বলেন, 'এই জায়গাটা তো আমরাই কিনে নিতাম। তুমি অন্য জায়গায় কেন বিক্রি করলে? এখন আমাদের যাতায়াতের সমস্যা হবে।' এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। এরই মাঝে খরিদকৃত জায়গায় মিল দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন মালিক শহীদ মিয়া। মিল চালু করতে আলমগীরের ঘরের উপর দিয়ে বিদ্যুতের লাইন নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এতে আলমগীরের বাবা তাহির আলী বাধা প্রদান করলে থেমে যায় মিল স্থাপনের প্রক্রিয়া। মূলত এ থেকেই জীঘাংসাবশতঃ ঘটনার সূত্রপাত বলে জানা গেছে।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান পিপিএম। তার সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাহেব আলী পাঠান (অপরাধ) ও সহকারী পুলিশ সুপার (তাহিরপুর সার্কেল) মো. বাবুল আক্তার।

এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সাইফুল আলম বলেন, জোড়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা রুজু হয়েছে। মামলায় ১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

 

বিআর/আরআর-০৩