গোলাভর্তি ধান, ঈদের কেনাকাটায় খুশির আমেজ

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ ও আলী আহমদ, জগন্নাথপুর


মে ১২, ২০২১
০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন


আপডেট : মে ১২, ২০২১
০৭:১৪ পূর্বাহ্ন



গোলাভর্তি ধান, ঈদের কেনাকাটায় খুশির আমেজ

দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের অন্যতম প্রধান এই ধর্মীয় উৎসব গতবারের মতো এবারও এসেছে করোনার দুঃসময়ে। করোনার থাবায় মানুষের জীবন যখন বিপন্ন, তখন ঈদের বেচাকেনায় স্বাস্থ্যবিধি মানার কড়া নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কিন্তু ঈদের কেনাকাটার আনন্দের স্রোতে যেন ভেসে গেছে সেই কড়া নির্দেশনা। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ধানের দামও মিলছে ভালোই। সেই সঙ্গে এসেছে প্রবাসীদের পাঠানো টাকা। তাই জীবনের ঝুঁকি বিবেচনার চেয়ে নতুন পোশাক কেনার আনন্দটাই বড় হয়ে গেছে হাওরপাড়ের মানুষের কাছে। এমন দৃশ্য দেখা গেছে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ ও জগন্নাথপুরে। 

আমাদের জামালগঞ্জ প্রতিনিধি বিশ্বজিত রায় জানান, হাওরের জনপদ জামালগঞ্জে সবেমাত্র বৈশাখী ফলন ঘরে তোলার কাজ শেষ হয়েছে। এমন মুহূর্তে এসেছে মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। তাই ফুরফুরে মেজাজে ঈদের কেনাকাটা সারছেন হাওরপাড়ের কৃষিজীবী মানুষেরা। করোনাভীতি উপেক্ষা করে ধনী-গরিব সবাই ভিড় করছেন পোশাক-পরিচ্ছদের দোকানে। পছন্দের জিনিসটি কিনতে বিপনিবিতানসহ গলির দোকানগুলোতেও ভিড় করছেন অসংখ্য মানুষ। ক্রেতাদের তুষ্ট করতে দম ফেলার ফুরসত মিলছে না বিক্রেতাদের। দোকানে দোকানে উপচেপড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়েছে।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উভয়েই খোশ মেজাজে আছেন। কেউ কেনাকাটা, কেউ বেচাবিক্রিতে মহাব্যস্ত সময় পার করছেন। উভয়পক্ষের মাঝেই আনন্দের ভাব ফুটে উঠছে। ফসল ও দাম দুটোই ভালো হওয়ায় কৃষক পরিবারগুলোর কেনাকাটায় বাড়তি আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে। তাই এবারের ঈদ বাজার সরগরম হয়ে উঠেছে। ফসল ঘরে তোলার পর পরই ঈদ আসায় ক্রেতাসাধারণের মাঝে অন্যরকম আনন্দ দেখা দিয়েছে। এ আনন্দ উপভোগ করছেন ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই।

স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাজারে আসা জামালগঞ্জের সাচনা বাজার ইউনিয়নের কুকড়াপশী গ্রামের উসমান গনি বলেন, এবার ফসল খুব ভালো হয়েছে। তাই বাজার করতেও ভালো লাগছে। এবারের ঈদ আনন্দেই কাটবে।

বাজার করতে আসা একই ইউনিয়নের সেরমস্তপুর গ্রামের আজির উদ্দিন জানান, এবারের বৈশাখী ফলন খুব ভালো হয়েছে। জমিতে ফলনকৃত ধানের দাম ভালো হওয়ায় এবারকার ঈদের হাট-বাজারে কারও মাঝে কৃপণতা নেই। সবাই মনের আনন্দে কেনাকাটা করছেন। এই আনন্দের কাছে করোনা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

স্বামীর সঙ্গে বাজারে আসা ভীমখালী ইউনিয়নের মামুদপুর গ্রামের মোমেনা আক্তার বলেন, ঈদ তো প্রতিবছরই আসে। তবে এবারের ঈদ মানুষ বাড়তি আনন্দে কাটাবে। কারণ সবার গোলা ধানে ভরে গেছে। ঈদের বাজার-সদাই করতে সবাই মোটামুটি ভালা দামে ধান বিক্রি করছে।

সাচনা বাজারের আকাশ ফ্যাশনের মালিক সুব্রত সরকার বলেন, বাজারে মানুষের উপস্থিতি ভালো। বেচাবিক্রিও মোটামুটি ভালোই হচ্ছে। ভালোভাবে ফসল ঘরে ওঠায় এ বছর মানুষের পকেটে টাকা আছে। কারণ দাম দিয়ে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে পারছেন। তাই তাদের মনের দিকটা খুব ভালো। সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে বাজারে আসছেন। মনের আনন্দে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে নিচ্ছেন। বেশ ভালোই লাগছে।

মহসিন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. জসীম উদ্দিন জানান, একটা শ্রেণি আছে যারা সারা বছরই কম-বেশি কেনাকাটা করে। এছাড়া নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া বাজার-সদাই তেমন করেন না। এবার ফসল ভালোভাবে ঘরে ওঠায় এই শ্রেণি অনেকটা আনন্দে ঈদের কেনাকাটা করছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর বাজারে স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতাসাধারণের উপস্থিতি একটু বেশি। বেচাকেনা মোটামুটি ভালোই হচ্ছে।

অন্যদিকে আমাদের জগন্নাথপুর প্রতিনিধি আলী আহমদ জানান, সুনামগঞ্জের প্রবাসী অধ্যুষিত জগন্নাথপুর উপজেলায় লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে ঈদের কেনাকাটার ধুম পড়েছে। হাট-বাজারগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। করোনাকালে এবারের ঈদ বাজারে রেকর্ড সংখ্যক নারী ক্রেতার ঢল নেমেছে ফুটপাত থেকে সুরম্য মার্কেটগুলোতে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ বছর বোরো ফসলের বাম্পার ফলনের কারণে এবং প্রবাসীদের সহযোগিতায় অন্য যেকোনো ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে জমজমাট বেচাকেনা চলছে। মহামারি করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের বেচাকেনা চলছে।

মঙ্গলবার (১১ মে) সরেজমিনে জগন্নাথপুর উপজেলা সদরের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ঈদকে সামনে রেখে কাপড়ের দোকানগুলোতে নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপচেপড়া ভিড়। সামাজিক দূরত্ব বজায়, মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার আর হাত ধোঁয়ার কোনো বালাই নেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে। এমনকি দোকানগুলোতে নেই করোনা সচেতনতার কোনো উদ্যাগ। 

জগন্নাথপুর পৌর শহরের টিএনটি সড়কের ঝলক ফ্যাশনের সামনে কথা হয় বাগময়না গ্রামের তাহিদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঈদের কাপড় কিনতে এসেছেন। তিনি জানান, লন্ডন থেকে ঈদ উপলক্ষে বড় ভাই কেনাকাটা করতে টাকা পাঠিয়েছেন। তাই সবাইকে নিয়ে পছন্দের পোশাক কিনছেন। করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি না মানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ মানছে না, তাই আমরাও মানছি না। সবকিছু তো স্বাভাবিক। 

নলুয়া হাওরপাড়ের বাসিন্দা বারুদ মিয়া বলেন, হাওরে এবার বাম্পার বোরো ফসল হয়েছে। গোলা ভরেছে ধানে। ঈদের আনন্দে সংসারে খুশি বিরাজ করছে। আর সেই খুশিতে পরিবারের লোকজনের জন্য নতুন জামা কিনতে বাজারে এসেছি।

সোনালী ব্যাংক জগন্নাথপুর শাখার ব্যবস্থাপক আল আমীন রাসেল বলেন, ঈদকে সামনে রেখে প্রতিদিন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আসছে। করোনাকালে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ আশানুরূপ হবে বলে মনে হচ্ছে। 

জগন্নাথপুর বাজার তদারক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহির উদ্দিন বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ও বোরো ফসলের বাম্পার ফলন হওয়ায় মানুষের হাতে টাকা আছে। তাই ঈদ বাজারে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। আমরা ব্যবসায়ীদের স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বললেও কেউ মানছে না। 

উজ্জ্বল গার্মেন্টসের মালিক রাজন দাশ বলেন, ক্রেতাদের চাপে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা করার সুযোগ নেই। আমরা চেষ্টা করলেও ক্রেতাদের কারণে তা মানা যাচ্ছে না। 

জগন্নাথপুর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আফছর উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ক্রেতাদের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে জগন্নাথপুরে ঈদের বাজার জমে উঠেছে। বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা করতে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেছি।

জগন্নাথপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, লকডাউন ও করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঈদের কেনাকাটায় উপচেপড়া ভিড় দুঃখজনক। সচেতন না হলে ঈদের আনন্দ মলিন হয়ে যেতে পারে- এ বিষয়টি ভাবতে হবে। আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করব।

 

বিআর/এএ/আরআর-০৩