আনোয়ার হোসেন মিঠু, নবীগঞ্জ
মে ২২, ২০২১
০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন
আপডেট : মে ২২, ২০২১
০৪:৩৬ অপরাহ্ন
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ নির্মাণ। মুজিববর্ষে হতদরিদ্র, ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের গৃহায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর মানবিক এ উদ্যোগ স্থানীয় প্রশাসনের দুরদর্শিতার অভাব ও প্রভাবশালীদের দাপটে থমকে আছে। এর ফলে ঘর নির্মাণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ঘর নির্মাণে ব্যবহৃত কাঠসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণসামগ্রী। এর ফলে সুবিধাভোগীদের মাথা গোঁজার ঠাই পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এদিকে উক্ত ভূমি নিজের লিজপ্রাপ্ত দাবি করে বিজ্ঞ হবিগঞ্জ সহকারী জজ আদালতে একটি স্বত্ব মামলা দায়ের করেছেন আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যক্তি। ফলে আদালত নির্মাণ কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করেছেন। সেই সঙ্গে নবীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করেছেন। এতে ৮টি ঘরের চলমান নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে ইনাতগঞ্জের দীঘিরপাড় এলাকায় সরকারি ভূমি বন্দোবস্তপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার স্বপ্নের ঘরে উঠতে পারছে না ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮টি পরিবার। অন্যদিকে দেরিতে হলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজ্ঞ আদালতে কারণ দর্শানোর জবাব দাখিল করেছেন।
জানা গেছে, সারা দেশের ন্যায় নবীগঞ্জ উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক উদ্যোগে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উপজেলায় ৩৯০টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা প্রণয়ন করলে প্রথম পর্যায়ে ১১০টি গৃহ ও দ্বিতীয় ধাপে ৪০টি গৃহ নির্মাণের বরাদ্দ এলে নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে আরও ২০টি ঘর নির্মাণের বরাদ এলেও এগুলোর কাজ এখন পর্যন্ত শুরুই হয়নি, যা বিগত ২৩ জানুয়ারি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকসহ উপজেলা প্রসাশন পর্যায়ক্রমে ৮৭টি নির্মিত গৃহ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে হস্তান্তর করেন। ওই সময় ইনাতগঞ্জ বাজার সংলগ্ন দীঘিরপাড় এলাকায় সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ২২.৭১ শতক ভূমির মধ্যে ৮ জন ভূমিহীন ও গৃহহীনের মাঝে ১৬ শতক ভূমি বন্দোবস্ত দিয়ে ৮টি গৃহ নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেন। একেকটি গৃহ নির্মাণে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা করে বরাদ্দ রয়েছে।
নির্মাণ কাজ শুরু হলে আহমদ আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যক্তি ভূমি তার নামে বন্দোবস্ত দাবি করে নির্মাণ কাজে বাধা দেন। এতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুমাইয়া মমিন তাকে একাধিকবার নোটিশ দিলেও তিনি উপযুক্ত কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। গৃহ নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে এলে উপজেলা প্রশাসন ১ম পর্যায়ে ৬০টি ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে উদ্বোধনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও গত ২৩ জানুয়ারি মাত্র ২৫টি ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয় উপকারভোগীদের মাঝে। নির্মিত বাকি ঘরগুলো ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে পর্যায়ক্রমে বুঝিয়ে দিলেও ইনাগঞ্জের ৮টি ঘর আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আটকা পড়ে। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ওই ৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের ঘরপ্রাপ্তি।
আরও জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক উদ্যোগের ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে এ পর্যন্ত ৮৭টি গৃহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে কপাল পুড়েছে ইনাতগঞ্জের ভূমিহীন ও গৃহহীন ৮টি পরিবারের। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ করে খাস জমি প্রদান করে ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার কথা রয়েছে। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি আধাপাকা ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। একই ডিজাইনে বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। রান্নাঘর, সংযুক্ত টয়লেট ও ইউটিলিটি স্পেসসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হবে বলা হলেও ইনাতগঞ্জ দিঘীরপাড়ে নির্মিতব্য ৮টি ঘরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হলেও আবুল কালামের মামলা দায়েরের ফলে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ৮টি অসহায় পরিবার। এছাড়া নির্মিত ঘরের মান নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে আবুল কালাম আজাদের দায়ের করা মামলার জবাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মো. মহি উদ্দিন বলেছেন, আবুল কালাম আজাদের কোনো প্রকার বৈধ কাগজ নেই। তিনি ইতোপূর্বেও কাগজ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ভূমি প্রকৃত অর্থে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত, যা এসএওআরএস খতিয়ানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড বিদ্যমান রয়েছে। উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের মোস্তাফাপুর মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ১২৪/১২০০ দাগে মোট ২২.৭১ শতক ভূমি নদী শ্রেণি হিসেবে এসএ রেকর্ডে বিদ্যমান ছিল। বিগত আরএস জরিপে উল্লেখিত ভূমি ৬৩২ দাগে আউশ শ্রেণি হিসেবে ০.০৩০০ একর, ৬৩৫ দাগে লায়েক পতিত শ্রেণি হিসেবে ০.০৬০০ একর, ৬৩৬ দাগে চারা শ্রেণি হিসেবে ০.৩৬০০ একর ও ৬৩৭ দাগে আউশ শ্রেণি হিসেবে ০.২৮০০ একর ভূমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসকের নামে রেকর্ড হয়। এর মধ্যে মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদেও জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা ২০২০ এর আওতায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক ১৯/২০২০-২০২১ ইং নম্বর স্থায়ী বন্দোবস্ত মোকদ্দমায় ইনাতগঞ্জের মো. আলফু মিয়া গং, হারুন মিয়া গং, মো. ইছব আলী গং, মো. ফরাস উদ্দিন গং, মো. আব্দুল নুর গং, মো. ছমির উদ্দিন গং, অধীর চন্দ্র দাশ গং ও মো. জিলু মিয়া গংদের মাঝে বন্দোবস্ত প্রদানপূর্বক নবীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি সম্পাদন করে দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে তাদের নামে নামজারি করা হয়েছে।
উল্লেখিত ভূমিতে সরকারি অর্থায়নে গৃহ নির্মাণের কাজ শুরু হলে আবুল কালাম আজাদ নামের ওই ব্যক্তি বাধা প্রদান করেন। কিন্তু তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে নির্মাণকাজ অব্যাহত থাকে, যা চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি উদ্বোধন ও নির্মিত গৃহ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সহকারী জজ আদালতের নিষেধাজ্ঞার আদেশ এলে তা আটকা পড়ে যায়। নির্বাচনী কার্যক্রমের কারণে উপজেলা প্রশাসন আদালতের জবাব বিলম্বে প্রেরণ করে। ফলে পরবর্তী আদেশ না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর মানবিক উদ্যোগের ৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার তাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া স্বপ্নের বাড়িতে উঠতে পারছেন না।
এ ব্যাপারে আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আনুমানিক ১৯৭৩/৭৪ সালে তিনি স্থায়ী বন্দোবস্ত নেন। এছাড়া তিনি আর কোনো তথ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করে বলেন, যা বলার আদালতে বলব।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুমাইয়া মমিন জানান, উল্লেখিত ভূমিটুকু সরকারি খাস ভূমি। বিধি মোতাবেক মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ৮ জন ভূমিহীনের মাঝে ১৬ শতক ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান করে আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দেওয়া হয়েছে। আবুল কালাম আজাদের দাবি অবৈধ ও অযৌক্তিক। এই জায়গা সরকার কারও নামে স্থায়ী বা অস্থায়ী বন্দোবস্ত বা লিজ প্রদান করেনি। তবে একাধিকবার তাকে (আজাদ) ডাকার পরও তিনি বৈধ কোনো কাগজপত্র নিয়ে হাজির হননি। বিজ্ঞ সহকারী জজ আদালতে জবাব প্রদান করা হয়েছে। আদালতের পরবর্তী আদেশ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে গতকাল শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি খালের পাড় ঘেঁষা ১৬ শতক ভূমি ৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বন্দোবস্ত প্রদান করেছেন উপজেলা ভূমি অফিস। পরে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ৮টি আধাপাকা ঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৪টি ঘরের আংশিক দেয়ালের কাজ শেষ হয়েছে। অপর ৪টি ঘরের চতুর্দিকে ইটের দেয়াল নির্মাণের কাজ শেষ করে উপরে টিন লাগানো, আস্তর ও বারান্দার কাজ করাকালে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আসে। ফলে ভেস্তে যেতে বসেছে ভূমিহীনদের ওই ৮টি বাড়ি পাওয়া।
এএম/আরআর-০১