সিলেটে পূরণ হচ্ছে না ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা

শুয়াইব হাসান


জুন ০৫, ২০২১
১২:০৫ পূর্বাহ্ন


আপডেট : জুন ০৫, ২০২১
১২:০৮ পূর্বাহ্ন



সিলেটে পূরণ হচ্ছে না ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা

সিলেটে এ বছর বোরো’র বাম্পার ফলন হলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান কিনতে পারছে না সরকার। সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে কৃষকের অনীহা এবং আড়ৎদাররা সরাসরি কৃষকের খলা থেকে ধান কেনায় লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এ বছর ২৭ টাকা কেজি দরে ১ হাজার ৮০ টাকায় প্রতি মণ ধান কেনার সিদ্ধান্ত সরকারের।

সিলেট বিভাগের চার জেলায় ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ৫৪ হাজার ২৬৩ টন; যা মোট উৎপাদনের মাত্র দুই শতাংশেরও কম। গত ৩১ মে সোমবার পর্যন্ত মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১০ শতাংশ ধান কেনা হয়েছে।

চার জেলার খাদ্য অফিসের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ উপজেলায় গুদামে ধান দিতে কৃষকরা অনীহা দেখাচ্ছেন। শর্তের জটিলতা থাকায় তাদের এই অনাগ্রহ। অন্যদিকে, বাজারে ধানের দামও বেড়েছে। এ কারণে অধিক লাভের আশায় বহু কৃষক এখনই ধান বিক্রি করছেন না।

কৃষকরা বলছেন, ধান ভালোভাবে শুকিয়ে, চিটা ও আগাছা পরিষ্কার করে সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে হয়। যে কারণে অতিরিক্ত শ্রমের পাশাপাশি পরিবহন খরচও বাড়ে। সব মিলিয়ে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা তারা বাড়িতে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে পাচ্ছেন।

সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান কেনা হবে সুনামগঞ্জ জেলায়। ১১ উপজেলা থেকে ২৫ হাজার ৮৭০ টন ধান কেনা হবে। হবিগঞ্জে কেনা হবে ১১ হাজার ১৬৫ টন, সিলেট জেলায় ১০ হাজার ৫১৫ টন এবং মৌলভীবাজারে ৬ হাজার ৭১৩ টন।

এর মধ্যে সুনামগঞ্জে গত সোমবার পর্যন্ত কেনা হয়েছে ৪ হাজার ৪৩৪ টন ধান, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ। মৌলভীবাজারে কেনা হয়েছে ১ হাজার ৬শ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২৪ শতাংশ। সিলেট জেলায় কেনা হয়েছে ৩ হাজার ২৩৮ টন; যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩১ শতাংশ এবং হবিগঞ্জে কেনা হয়েছে ২ হাজার ৪শ টন; যা লক্ষ্যমাত্রার ২১ শতাংশ।

হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে বছরের সবচেয়ে বেশি বোরো উৎপাদন হলেও এই দুই জেলায় ধান কেনার হার সবচেয়ে কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু ধান কেনার ক্ষেত্রে ময়েশচার (আদ্রতা) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ কারণে এখন ধান কেনায় আরও ভাটা পড়বে।

জামালগঞ্জে বোরো চাষি এরশাদ মিয়া বলেন, ‘সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে অনেক বিষয় ভাবতে হয়। ধান শুকিয়ে নিয়ে গুদামে গেলে বলা হয় ঠিকমতো শুকানো হয়নি। অথচ, এই ধান আমরা সারাবছর রেখে খেতে পারি, ধান নষ্ট হয় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গুদামে ধান দিতে হলে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো নয়। কষ্ট করে বহন করে ধান নিয়ে সেটা বিক্রি করতে না পারলে হয়রানিতে পড়তে হয়। আমরা পুরোপুরি না শুকিয়েও প্রতি মণ ধান ৯০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছি। তাহলে সরকারি গুদামে নিয়ে যাব কেন?’

জানা গেছে, আশুগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার চাতাল ও মিল মালিকরা তাদের এজেন্টের মাধ্যমে কৃষকদের খলা থেকে সরাসরি ধান কিনে নিচ্ছে। আবার অনেক কৃষক ধান বিক্রি না করে দাম বাড়ার অপেক্ষায় আছেন।

আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি সাইদুর রহমান আসাদ জানান, সুনামগঞ্জে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে। প্রায় ১৫ লাখ টন ধান উৎপাদন হলেও সরকার মাত্র ২৫ হাজার ৮৭০ টন কিনবে। কিন্তু চাল কিনবে বেশি। সেটা মিল মালিকদের কাছ থেকে কেনা হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই কৃষকের চেয়ে মিল-চাতাল মালিকরাই বেশি লাভবান হবে। গত বছর ৩২ হাজার টন ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবার সেটি কমিয়ে ২৫ হাজার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছেন, সরকারিভাবে নির্ধারিত ধানের দাম আর বাজারের দামের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় সেটি কৃষকদের পছন্দ নয়।

আমাদের প্রতিনিধি আরও জানান, চাতাল মালিকরা কৌশলে আগে থেকেই কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করে থাকেন। এমনকি বৈশাখ আসার আগেই তারা কৃষকদের টাকা ধার দিয়ে রাখেন যা পরে ধানের বিনিময়ে মেটাতে হয়। সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নকীব সাদ সাইফুল ইসলাম জানান, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সুনামগঞ্জে ধান সংগ্রহের কাজটি কিছুটা কঠিন হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২০০ টন ধান কেনা হয়েছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও দিরাই উপজেলায় ধানের সংগ্রহ ভালো। তবে ধর্মপাশায় ধান কেনা কার্যক্রম এখনও পিছিয়ে আছে।

কৃষি বিভাগ বলছে, লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচন করে ধান ক্রয় করার কথা রয়েছে। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রত্যেকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৩ টন ধান কেনা হচ্ছে।

তবে, ৩০ মে’র মধ্যে অনেকে ধান দেননি। তাই, কার্ডধারি বৈধ যেকোনো কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) মো. দিলদার মাহমুদ বলেন, ‘লটারির মাধ্যমে নির্ধারিত কৃষক ছাড়াও শুরু থেকেই যেকোনো বৈধ কৃষক ধান দিতে চাইলে আমরা নিচ্ছি। তাদেরকে ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে।’

হবিগঞ্জ জেলায় এ বছর ১১ হাজার ১৮৫ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে; যা মোট বোরো উৎপাদনের মাত্র দেড় শতাংশ। জেলায় এবার ৭ লাখ ৮২ হাজার ২৪২ টন ধান উৎপাদন হয়েছে।

খাদ্য কর্মকর্তা একমত হয়েছেন, বাজার ও সরকারি দামে তেমন পার্থক্য নেই। এর মধ্যে নানা শর্ত থাকায় কৃষকরা গুদামে ধান না দিয়ে পাইকারিতে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

জেলার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারিতে এখন মোটা ধান মণপ্রতি ৮৫০ থেকে ৯শ টাকায় ও চিকন ধান ৯৫০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোথাও তারচেয়ে বেশি।

বানিয়াচং উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের কৃষক জগৎ সরকার জানান, এ বছর বাজারে ধানের দামও বেশি। যে কারণে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে চাচ্ছেন না তারা।

আজমিরীগঞ্জ উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের কৃষক সুবল দাস বলেন, ‘সরকার ১৪ শতাংশ আদ্রতাপূর্ণ ধান চায়। ধানে সামান্য চিটা থাকলে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। গাড়ি দিয়ে গুদামে দিয়ে আসতে হয়। তাই এতসব বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করে এ বছর সরকারের কাছে ধান বিক্রি করছি না।’

সিলেট জেলায় ধান কেনার অগ্রগতি কিছুটা ভালো। ১০ হাজার ৫১৫ টন ধান কেনার লক্ষ্য। জেলার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বিশ্বনাথ উপজেলা। গোলাপগঞ্জ ও কানাইঘাট উপজেলায় কেনা হয়েছে সবচেয়ে কম।

সিলেট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নয়ন জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘সিলেট জেলায় এবার ধান সংগ্রহে অগ্রগতি ভালো। গত আমন ফসলের সময় ১০ শতাংশ ধান কেনা যায়নি। এবার এরই মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।’

তবে, বাজারে দিন দিন ধানের দাম বাড়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন তিনি।

মৌলভীবাজারেও একই চিত্র। বড়লেখা ও সদর উপজেলায় ধান সংগ্রহের হার সবচেয়ে কম। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মোখলেছুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।