বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ
জুন ০৭, ২০২১
১২:১৪ পূর্বাহ্ন
আপডেট : জুন ০৭, ২০২১
১২:১৪ পূর্বাহ্ন
ভাটির বন্দরখ্যাত সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের সাচনা বাজার নানা সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়েছে। জেলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এ বাজারটিতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, গণশৌচাগার, গভীর নলকূপ, অটো স্ট্যান্ডসহ স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের প্রয়োজনীয় সব সুবিধা না থাকায় অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এছাড়া বৃষ্টি হলে বাসা-বাড়ির দূষিত পানি নির্গত হয়ে বাঁধ বাজার ও নতুন বাজারে চলাচলে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও ভোগান্তি নিরসনে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এছাড়া বাজারের যান ও জনচলাচলের মূল গলিটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে থাকায় বাজারে আসা মানুষজনকে প্রতিনিয়ত গাদাগাদি করে পথ চলতে হচ্ছে। এ অবস্থায় জরুরি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স কিংবা বড় কোনো গাড়ি নিজ গন্তব্যে যেতে মারাত্মক সমস্যায় পড়ছে। গত ৩ বছর আগে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতিতে তৎকালীন ইউএনও শামীম আল ইমরান উদ্যোগ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের গলি থেকে উচ্ছেদ করলেও এখন পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে বাজার ফের আগের অবস্থাইয় চলে গেছে।
এসব সমস্যা দূরীকরণে সরকারের স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরী কোনো ভূমিকা নেই। বাজারের এমন হযবরল অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। উন্নয়ন অগ্রগতিতে দেশ এগিয়ে চললেও বাজার উন্নয়নে কেউ এগিয়ে না আসায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মাঝে চরম অসন্তোষ কাজ করছে। শতবর্ষী সাচনা বাজারে শুধু এখানকার মানুষই নয়, পার্শ্ববর্তী অন্য উপজেলার মানুষও হাট-বাজার সারতে ছুটে আসেন। সরকার এ বাজার থেকে মোটা অংকের রাজস্বও আদায় করছে। তারপরও বাজারের উন্নয়ন কাজ প্রতিশ্রুতির বেড়াজালেই আটকে আছে। এ অবস্থায় বাজারের সৌন্দর্যবর্ধন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও পথচারীসহ সকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।
বাজারের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষেরা জানিয়েছেন, সাচনা বাজারের আলাদা ঐতিহ্য আছে। প্রতিদিন প্রায় অর্ধকোটি টাকারও বেশি বেচাকেনা হয় এ বাজারে। সরকারও এখান থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব নিচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না সাচনা বাজারের। একটু বৃষ্টি হলেই পানি জমে বেহেলী রোড, সিএন্ডবি রোড, বাঁধ বাজার, লামাবাজার ও মধ্যবাজারসহ পুরো বাজার চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। দ্রুত বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সুবিধা না থাকায় জনভোগান্তি চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
অপরদিকে এত বড় বাজারে কোনো গণশৌচাগার (পাবলিক ট্রয়লেট) নেই। বাজারের উত্তর পাশে যাও একটি আছে, সেটিও ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এতে করে প্রকৃতির ডাক এলে ক্রেতা-বিক্রেতাসহ অপরিচিতজনকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সুপেয় পানির অভাব পূরণে নলকূপ আছে মাত্র একটি। এছাড়া বাজারে প্রবেশ করা শত শত রিকশা, অটোরিকশা, মোটরসাইকেলের নির্ধারিত কোনো স্ট্যান্ড নেই। তাই চালকেরা বাজারে যত্রতত্র যানবাহন দাঁড় করিয়ে যানজটের সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে প্রায়ই চালক, পথচারী ও ব্যবসায়ীদের মাঝে বাক-বিতণ্ডা লেগেই থাকে। পাশাপাশি আল-ভান্ডারী পয়েন্ট থেকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত রোড ডিভাইডারে বিভক্ত দুইপাশই ভাসমান ব্যবসায়ীদের দখলে থাকায় সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। এর মাঝে মালামাল বহনকারী ট্রাক-পিকআপ বাজারে প্রবেশ করলে স্বাভাবিক চলাচলে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এতসব সমস্যা উত্তরণে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ সকলের।
জানা যায়, এ বাজারের পূর্ব নাম ছিল কালীগঞ্জ বাজার। মূলত এটি সাচনা জমিদার বাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তির অংশ হিসেবে প্রায় ২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের নদীবন্দর হিসেবে একসময় এ বাজারের সুখ্যাতি ছিল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জাহাজ মালামাল নিয়ে সাচনা বাজারে নোঙর করত। ভাটি অঞ্চলের অন্যতম হাট ছিল এটি। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনায় বাজারটির বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক।
২০১৮ সালের ৪ মে বাজারের সৌন্দর্য-শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ শুরু করেছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আল ইমরান। ওইদিন উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক বাজারের গলিটি খালি করার কঠোর নির্দেশনা জারির পর নিজ উদ্যোগে গলি ছেড়ে বাজারের সৌন্দর্য ও সুশৃঙ্খল যাতায়াতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন অবৈধ ভাসমান ব্যবসায়ীরা। তার অংশ হিসেবে গলির মাঝখানে রোড ডিভাইডার স্থাপন করে উপজেলা প্রশাসন। পাশাপাশি গলির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অন্যত্র পুনর্বাসনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজোবধি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। যার ফলস্বরূপ দখলমুক্ত জায়গা ফের দখল হয়েছে। বেড়েছে মানুষের দুর্ভোগ।
সাচনা নতুন বাজারের ব্যবসায়ী ও ছড়াকার পঙ্কজ শীল বলেন, 'বাজারের কথা আর কী বলব। বৃষ্টি হলে বাসা-বাড়ির ময়লাযুক্ত পানি রাস্তায় এসে দুর্গন্ধ ছড়ায়। রোগ-জীবাণুযুক্ত পানি জেনেও আমরা এর উপর দিয়ে হাঁটাচলা করছি। সবকিছু মিলে প্রাচীন এই বাজারটি অপরিচ্ছন্ন-অপরিষ্কার হয়ে পড়েছে। এগুলো দেখার কেউ নেই।'
সাচনা বাঁধ বাজারের ব্যবসায়ী সুনির্মল হালদার বলেন, 'সামান্য বৃষ্টি হলেই বাজারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। পানি জমে যাতায়াতে মারাত্মক ভোগান্তির সৃষ্টি হয়। পুরাতন এই বাজারটির আরও কত যে সমস্যা আছে সেগুলো আর বলতে চাই না। এমনিতে নেতার অভাব নেই, কিন্তু কাজের বেলায় কেউ নেই- এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।'
সাচনা চৌধুরী বাড়ির সৈকত ঘোষ চৌধুরী বলেন, 'পয়নিষ্কাশনের জন্য বাজারটিতে কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। হাজার হাজার লোকের জন্য স্যানিটেশন মাত্র একটি। তাও আবর্জনার স্তুপে চাপা পড়ে সেটি এখন বন্ধ! সরকার এ বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব নিলেও উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তাছাড়া ব্যবসায়ী মহলে সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সাচনা বাজার হয়তো একদিন বিলীন হয়ে যাবে। ঐতিহ্যবাহী এ বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। এর অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উন্নয়নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।'
সাচনা বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদ আল আজাদ বলেন, 'এ সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদাপানি জমে চলাচলে অসহ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এজন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি রইল।'
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব বলেন, 'ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াটি অচিরেই বাস্তবায়িত হবে এবং জামালগঞ্জে ড্রেন নির্মাণের কাজ শেষ হলেই সাচনা বাজারের কাজ শুরু হবে। এছাড়া পাবলিক টয়লেটের ব্যাপারটি এলজিআরডিতে দেওয়া আছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এগুলোর কাজ শুরু হবে।'
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, 'আগামী এক সপ্তাহ/১৫ দিনের মধ্যে ড্রেনের কাজ শুরু হবে। বাজারের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি বাজারকে সুশৃঙ্খল করতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী তাদেরকে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টা চলছে। আস্তে আস্তে বাজারের সব সমস্যাই দূর হবে।'
বিআর/আরআর-০৭