১১ বছরেও পূরণ হয়নি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি

বিশ্বজিত রায়, জামালগঞ্জ


জুন ১০, ২০২১
০৫:১৫ অপরাহ্ন


আপডেট : জুন ১০, ২০২১
০৫:১৫ অপরাহ্ন



১১ বছরেও পূরণ হয়নি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি
সেতুর অপেক্ষায় জামালগঞ্জের দুই লক্ষাধিক মানুষ

ফাইল ছবি

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে স্রোতস্বীনি সুরমা নদী। নদীটি স্বাভাবিক গতিতে নিরন্তর বয়ে চললেও এর বহমানতা আটকে দিয়েছে দুই পাড়ের জামালগঞ্জ ও সাচনা বাজারের অন্তত দুই লক্ষাধিক মানুষকে। দুই পাড়কে বিচ্ছিন্ন করা সুরমার উপর সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। এটি এখানকার মানুষের প্রাণের দাবি হলেও দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে আটকে আছে তা। এই সেতু কবে নির্মাণ হবে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা নেই। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রায় ১১ বছর অতিবাহিত হলেও সেতুর কাজ শুরু না হওয়ায় এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে অস্বস্তি কাজ করছে।

জানা যায়, সাচনা বাজারের বিপরীত পাড়ে উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসন, থানা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যাংক থাকায় জরুরি কাজে সাচনা বাজারের মানুষকে রোদ-বৃষ্টি ও ঝড়-ঝাপ্টার ঝুঁকি নিয়ে খেয়া পার হতে হচ্ছে। আবার সাচনা বাজার ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ব্যবসায়ীক প্রয়োজন কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু কিনতে জামালগঞ্জের মানুষকেও একইভাবে ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে সুরমা নদী। এতে করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, রোগী ও রোগীদের স্বজন, চাকরিজীবীসহ সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই কোনো না কোনোভাবে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এছাড়া অনেকের জরুরি কাজ সম্পন্নের তাগিদ থাকা সত্ত্বেও ফেরি চলাচলে সময়ক্ষেপণের ফলে যথাসময়ে কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে নদীর দুই তীরের অগণিত মানুষ একটি সেতু নির্মাণের জোর দাবি জানিয়ে এলেও তা বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে।

আরও জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যে জামালগঞ্জ উপজেলা একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানকার সাচনা বাজার ভাটি অঞ্চলের বন্দর হিসেবে বিবেচিত। ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সাচনা বাজারের আলাদা সুখ্যাতি রয়েছে। এ উপজেলায় আছে ছোট-বড় ৬টি হাওর। রয়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছের অভয়াশ্রম। মাছ ও ধান উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে জামালগঞ্জ। এছাড়া জাদুকাটা-ফাজিলপুর পয়েন্ট থেকে উত্তোলিত বালুর নিরাপদ ডাম্পিং স্পট এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত উদ্যোক্তাসহ সম্ভাবনাময় কর্মক্ষম জনশক্তি রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জামালগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হিসেবে চিহ্নিত হলেও উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে।

২০১০ সালের ১০ নভেম্বর সুনামগঞ্জ সফরে এসে তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাটি অঞ্চলের জীবনমান উন্নয়নে প্রত্যাশার আলো ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাচনা-জামালগঞ্জ সেতু নির্মাণের কথাও উল্লেখ ছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির প্রায় ১১ বছর অতিবাহিত হলেও আজ অবধি সেতু নির্মাণে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না থাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন সরকার দলের উন্নয়ন-অগ্রগতির স্বস্তিদায়ক ছাপ সর্বত্র লেগেছে যা দৃশ্যমান। তবে এক্ষেত্রে বঞ্চিত জামালগঞ্জের মানুষ। সমগ্র উপজেলায় উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন নেই বললেই চলে। তারপরও উপজেলাবাসী কী হচ্ছে কী হয়নি তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাদের একমাত্র দাবি সাচনা-জামালগঞ্জ সংযোগ সেতু। এটি নির্মাণ হলে বহুল আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হবে তাদের। তাই সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ চাইছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা দ্রুত এ কাজে হাত দিয়ে উপজেলাবাসীর প্রাণের দাবিটি পূরণ করবে।

জামালগঞ্জ থেকে সাচনা বাজারে কেনাকাটা করতে আসা ভীমখালী ইউনিয়নের বনশ্রীপুর গ্রামের এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এইডা বহুত পুরানা কিচ্ছা। অনেক দিন ধইরা হুনতাছি ব্রিজ হইব। এখনও হইতাছে। কোনদিন যে হইব, এইডার কোনো ইস্টিশন নাই। ব্রিজডা হইলে আমরার ফুয়া-ফুরিন্তে আরামে আইত-যাইত পারলনে। হখলের খুব উপকার হইলনে।

জামালগঞ্জ সদর ইউনিয়নের শাহপুর গ্রামের পত্রিকা হকার মো. সালাউদ্দিন বলেন, আমরা অনেকদিন ধইরাই খালি হুনতাছি এইখানে ব্রিজ হইব। কিন্তু আজ পর্যন্ত এইখানে ব্রিজ হইতাছে না। ব্রিজটা না হওয়ায় মেঘ-বৃষ্টির মাঝে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তারার জরুরি কাজ সারতে এই পাড়-ওই পাড় হইতাছে। এই জায়গাত ব্রিজ হইলে খুব ভালা হইব। হখলের কষ্ট দূর হইব।

সাচনা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিশেন্দু গোস্বামী বলেন, ১৯৮৫ সালে আমি যখন জামালগঞ্জ হাইস্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই নদী পার হয়ে আসছি। ছোট নৌকায় পার হতে গিয়ে নৌকাডুবিতে বইখাতা ভিজে যাওয়ার ঘটনাও ঘটত। যদিও এখন নৌকা ডুবে না, তবে ঝড়-বৃষ্টিতে ঝুঁকি ও ভোগান্তি দুটোই আছে। এছাড়া জরুরি রোগী নিয়ে কেউ সহজে জামালগঞ্জ হাসপাতালে যেতে পারেন না। দুই পাড়ের মানুষের নিরাপদ পারাপারে এখানে একটি সেতু নির্মাণ জরুরি। দীর্ঘদিনের এ দাবি সহসাই পূরণ হবে এমন প্রত্যাশা রাখি।

জামালগঞ্জ কিন্ডারগার্টেনের সিনিয়র শিক্ষক মো. আলী আমজাদ বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাচনা বাজার-জামালগঞ্জে সেতু নির্মাণের দাবি আরও জোড়ালো হয়। কিন্তু ক্ষমতার একযুগেরও অধিক সময় অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত সেতুটির নির্মাণ কাজ আলোর মুখ দেখেনি। আশা করি সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে দ্রুতই এ সেতুর নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

জামালগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. ওয়ালী উল্লাহ সরকার বলেন, নদী পারাপারে প্রতিনিয়ত মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। কেউ রোগী নিয়ে, কেউ বা জরুরি কাজ সারতে গিয়ে। দেশ উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছালেও জামালগঞ্জের মানুষ উন্নয়নবঞ্চিত। সুরমা নদীতে সেতু দিয়ে এ উপজেলার মানুষকে উন্নয়নের অংশীদার করুন।

এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ এলজিইডি'র এক দায়িত্বশীল প্রকৌশলী জানিয়েছেন, সাচনা-জামালগঞ্জকে যুক্ত করতে সুরমা নদীর উপর সেতু নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এ সেতু নির্মাণে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

সিলেট-সুনামগঞ্জ সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা আক্তার খানম বলেন, সাচনা-জামালগঞ্জ সেতু নির্মাণ তিনটি উপজেলার প্রাণের দাবি। তিন উপজেলার মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সেতুটি আমাদের সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে। এর সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সেতুটির নির্মাণ বর্তমান সরকারের আমলেই সম্পন্ন করবেন এটা আমি বিশ্বাস করি।


বিআর/আরআর-০১